২ এপ্রিল, ২০২৪ ১০:৩৯ এএম
রোযা গুরুত্বপূর্ণ একটি মৌলিক ইবাদাত। আমাদের জীবনে রোযার গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। অন্যান্য ইবাদতের ন্যায় রোযার মধ্যে আমাদের জন্য শিক্ষণীয় অনেক বিষয় রয়েছে। আমাদের জীবনকে সুন্দরভাবে সাজাতে হলে এসব শিক্ষা গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। রোযা তথা যে কোনো ইবাদত হতে যদি কোনা শিক্ষনীয় কিছু নাই থাকে তা হলে তা লক্ষ্যহীন। আর লক্ষ্যহীন কোনো ইবাদত আল্লাহ তায়ালা তার বান্দার জন্য নিশ্চয়ই নির্দ্ধারণ করবেন না, এটাই স্বভাবিক। আমরা জানি রোযা একটি কষ্টসাধ্য ইবাদত। অহেতেুক আল্লাহ বান্দাকে কষ্ট দেবেন তা হয় না। সেহেতু রোযা হতে কিছু শিক্ষনীয় বিষয় অবশ্যই থাকবে। নিম্নে রোযার গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি শিক্ষা সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো:
এক. হারাম থেকে দুরে থাকা:
রোযার দিনে শতভাগ হালাল ও পবিত্র খাদ্য গ্রহণ কে আমরা একশতভাগ হারাম মনে করি। ভুলে মুখে নিলেও স্বরণে আসার সঙ্গে সঙ্গে আমরা তা ফেলে দেই। নিজের বিবাহিত/বিবাহিতা স্বামী-স্ত্রীর একান্ত মুহূর্তের সম্পর্ককে আমরা পরস্পরে পরপুরুষ কিংবা পরস্ত্রীর মতো হারাম মনে করি। রমজানের দিনের বেলায় আল্লাহ তায়ালা একটি মাস ধরে হালাল খাদ্যকে হারাম এবং হালাল স্ত্রীকে হারাম করে দিয়ে তা মানার বাধ্যবাধকতামূলক অনুশীলনের ব্যবস্থা করেছেন। এটি আমরা অক্ষরে অক্ষরে পালন করি বটে; কিন্তু এর উদ্দেশ্য কী তা আমরা অনেকেই বুঝতে চেষ্টা করি না। এতে কী লাভ? তাও অনেকেই হৃদয়ঙ্গম করতে ব্যর্থ।
এর উদ্দেশ্য হলো: মানুষ যদি একটি মাস ধরে এভাবে হালালকেও হারাম মনে করে তাকে পরিহার করতে অভ্যস্ত হয়, তাহলে সে বছরের পরবর্তী এগারটি মাস অন্ততঃ হারামকে অবশ্যই হারাম হিসেবে বর্জন করতে পারবে। মহান আল্লাহ কর্তৃক ঘোষিত কোনো নিষিদ্ধ কর্মকাণ্ড তার দ্বারা সংঘটিত হবে না। পরস্ত্রী ও হারাম সম্পদের প্রতি সে ঘুণাক্ষরেও তাকাবে না। কিন্তু, তা কি আমরা অর্জন করতে পেরেছি? পারিনি এ কারণেই যে, আমরা তো উদ্দেশ্যহীন গন্তব্যের পথিক। না খেয়ে রোযা পালন করার কথা, তাই করলাম। কেন যে করলাম তা বুঝলাম না। এভাবেই কাটিয়ে দিলাম সারাটি জীবন। আমাদের রোযা আসলেই কি পরিপূর্ণ হলো? রাসুল সা. বলেছেন: “খাওয়া ও পান করা থেকে বিরত থাকার নাম রোযা নয়; বস্তুতঃ রোযা হল: অনর্থক ও অশ্লীল কাজ হতে বিরত থাকা।”(হাকেম-১৫৭০)
দুই. তাকওয়া অর্জন:
রোযার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হচ্ছে তাকওয়া বা আল্লাহসচেতনতা তৈরি। তাকওয়া অর্জনই রোযার মূল উদ্দেশ্য। এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন, “হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোযা ফরয করা হয়েছে যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর ফরয করা হয়েছিল যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।” (সুরা বাকারা, আয়াত-১৮৩) কেউ যদি রোযা রেখেও তাকওয়া অর্জন করতে না পারে অর্থাৎ রোযা রেখেও গুনাহের কাজ ছাড়তে না পারে তাহলে তার রোযার উদ্দেশ্য পূরণ হবে না। এরূপ রোযা আল্লাহ তায়ালার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। এ সম্পর্কে আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহ আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. বলেছেন, “যে ব্যক্তি পাপ, মিথ্যা বা অন্যায় কথা, অন্যায় কর্ম এবং মূর্খতাসুলভ কর্ম ত্যাগ করতে না পারবে তার পানাহার ত্যাগ করাতে আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই।”(বুখারি- ১৯০৩, ৬০৫৭)
তিন. সহানুভূতি:
যারা সারা বছর পেট পুরে পানাহার করেন তারা ক্ষুধার্ত মানুষের কষ্টের কথা অনুধাবন করার কথা নয়। মহান আল্লাহ একটি মাস রোযা রাখার বিধান করে এ বিষয়টি হাতে কলমে শিক্ষা দিলেন। যাতে বিত্তশালীগণ অসহায় গরীব ক্ষুধার্ত মানুষদের ক্ষুধার কষ্ট বুঝতে পারে। ফলে তাদের প্রতি সহানুভূতি সৃষ্টি হবে। বিত্তশালীরা এখানকার এ শিক্ষা নিয়ে সারা বছর কাজে লাগাবে অসহায় মানুষের তরে। এ জন্য এ মাসের আরেক নাম ‘সহানুভূতির মাস’। এ সম্পর্কে সালমান রা. হতে বর্ণিত একটি দীর্ঘ হাদীসের একাংশে রাসূলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেছেন, “ইহা মানুষের প্রতি সহানুভুতি প্রদর্শনের মাস। যে ব্যক্তি এই মাসে আপন গোলাম (কর্মচারী ও খাদেম) এর কাজের বোঝা হালকা করে দেয়, আল্লাহ তায়ালা তাকে মাফ করে দেন এবং জাহান্নামের আগুন হতে মুক্তি দান করেন।” (ইবনে খুজাইমা, বায়হাকি, ইবনে হিব্বান)
বাস্তব সত্য হলো; সহানুভূতি প্রদর্শনের এ শিক্ষা সারা বছর আমাদের মাঝে অনুপস্থিত।
চার. ইখলাস:
নামায, হজ্জ, যাকাত, জিহাদ ইবাদাতে রিয়া বা লোক দেখানো মনোভাবের সম্ভাবনা থাকে। নামায, হজ্জ, জিহাদ গোপনে করা যায় না। কেউ না কেউ তা দেখে, সেহেতু এতে রিয়া বা লৗকিকতার সুযোগ থাকে। কিন্তু রোযার মধ্যে রিয়া বা লোক দেখানোর কোনো সম্ভাবনা নেই। যিনি রোযা রেখেছেন তিনিই তার সাক্ষী। রোযাদার ইচ্ছা করলে ঘরের কোনায় চুপিসারে পানাহার করতে পারেন, কিন্তু তা তিনি করেন না। তিনি রোযা আছেন কি না, তা তিনিই জানেন, অন্য মানুষের জানার কথা নয়। রোযা একমাত্র আল্লাহ তায়ালার উদ্দেশ্যেই করা হয়। এজন্য রোযার প্রতিদান আল্লাহ তায়ালা নিজ হাতে দিতে চেয়েছেন। এ ব্যাপারে আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেন, “আল্লাহ তায়ালা বলেন, “আদম সন্তানের প্রত্যেক আমলের সওয়াব দশ গুণ থেকে সাতশক গুণ বৃদ্ধি করা হয়। একমাত্র ব্যতিক্রম হলে রোযা। রোযা আমার জন্য। আর রোযার প্রতিদান আমি নিজেই দেব। কেননা রোযাদার একমাত্র আমার সন্তুষ্টির জন্যই তার কামনাবাসনা ও পানাহার থেকে বিরত থাকে।” (বুখারি-১৮৯৪)
তাই রোযা পালনের মাধ্যমে একনিষ্ঠতা অর্জনের কথা, যা আমরা অন্যান্য ইবাদতের বেলায় প্রয়োগ করতে পারি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এ শিক্ষা আমরা গ্রহণ করতে প্রায় ব্যর্থ হয়েছি।
পাঁচ. সবর বা ধৈর্য:
রোযা পালনের মাধ্যমে দুঃখ-কষ্টে সবর করার শিক্ষা রয়েছে। মুমিনগণ রমজানে দীর্ঘ একমাস রোযা রেখে আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির জন্য ক্ষুধা-পিপাসা ও নফসের খাহেশাত দমন করার কষ্ট তারা অম্লান বদনে সহ্য করে নেয়। তাই রমযানকে সবর বা ধৈর্যের মাস বলা হয়। এ সম্পর্কে সালমান রা. হতে বর্ণিত একটি দীর্ঘ হাদীসের একাংশে রাসূলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেছেন, “ইহা সবরের মাস। আর সবরের প্রতিদান জান্নাত।” (ইবনে খুজাইমা, বায়হাকি, ইবনে হিব্বান) এ একটি মাস সবর এর ট্রেনিং নিয়ে সারা বছর কাজে লাগাতে হবে এটাই কাম্য। কিন্তু তা গ্রহণ করা থেকে আমরা অনেক দুরে। এ আমল আমরা রোযার পরই বেমালুম ভুলে যাই।
ছয়. ভ্রাতৃত্ব:
রোযার মাধ্যমে মুমিনদের মাঝে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন মজবুত করার শিক্ষা দেয়া হয়। রোযার মাসে মুমিনগণ সওয়াবের আশায় একে অপরকে ইফতার করায়। এছাড়া রমজানে বিশেষ গুরুত্ব সহকারে পাঁচ ওয়াক্ত নামায ও তারাবীহ নামায পরস্পর পরস্পরের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে জামাতে নামায আদায় করে। তখন সব মুসলমান একে অপরের ভাইয়ের মত হয়ে যায়। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, “নিশ্চয় মুমিনগণ ভাই ভাই।“(সুরা হুজুরাত, আয়াত-১০) রোযার পরেও এ ভ্রাতৃত্বের বন্ধন অটুট থাকবে এটাই রোযার উদ্দেশ্য। কিন্তু তা আমরা রোযা পর্যন্তই পালন করি, পরে নয়।
সাত. ঐক্য:
সকল মুসলমান একই সময়ে অর্থাৎ রমযান মাসে একই নিয়মে অর্থাৎ সুবহে সাদিক হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও কামাচার হতে বিরত থেকে সম্মিলিতভাবে অর্থাৎ রাজা-প্রজা, ধনী-গরীব, ফর্সা-কালো, নারী-পুরুষ সকলেই একসঙ্গে আল্লাহর হুকুম রোযা পালন করে। এতে বিরাট ঐক্যের চিত্র ফুটে ওঠে। আর আল্লাহর হুকুম সম্মিলিতভাবে ঐক্যবদ্ধভাবে পালনের নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেছেন, “তোমরা ঐক্যবদ্ধভাবে আল্লাহর রজ্জুকে আকড়ে ধরো এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না।”(সুরা আলে ইমরান, আয়াত-১০৩) রমযানে ঐক্যের যে চিত্র মুসলমানের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়, রোযার পরেই তার অবসান ঘটে।
রমযানের পরে মুসলমানদের দেখলে মনে হয় না যে তারা কখনও ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ ছিল। অথচ এটি অস্তিত্ব রক্ষার অন্যতম হাতিয়ার। রাসুলে আকরাম সা. ইরশাদ করেন, “তোমরা ঐক্যবদ্ধভাবে জীবন-যাপন করো, সংঘবদ্ধ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে জীবন-যাপন করো না, কারণ বিচ্ছিন্ন জীবন-যাপন করলে শয়তানের কু-প্ররোচনায় আকৃষ্ট হয়ে পথভ্রষ্ট হয়ে যাবে।” (আবু দাউদ ও ইবনে মাজাহ)দূঃখের বিষয় মুসলমানদের বর্তমানে বিপর্যয়ের বড় কারণ হলো অনৈক্য। কিন্তু আমরা তো রমযান থেকে ঐক্যের শিক্ষা নিচ্ছি না।
আট. সম্প্রীতি:
রোযা মানুষের মাঝে বিদ্যমান ঝগড়া বিবাদ ও মারামারি-হানাহানি থেকে বিরত থাকার শিক্ষা দেয়। এভাবে পরস্পরের মাঝে সম্প্রীতি ও ভালোবাসা প্রতিষ্ঠার প্রতি উৎসাহ যোগায়। এ ব্যাপারে আবু হুরাইরা রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সা. ইরশাদ করেন, “যখন তোমাদের কারো রোযার দিন হবে, সে যেন অশ্লীল ভাষা প্রয়োগ না করে ও হৈ-হট্টগোল না করে। আর যদি কেউ গালাগালি করে অথবা তার সাথে লড়াই ঝগড়া করে, তাহলে সে যেন বলে যে, ‘আমি রোযাদার।”(সহিহ বুখারি-১৮৯৪, ১৯০৪; মুসলিম-১১৫১)
নয়. সুন্দর আচরণ:
মানুষের সঙ্গে সুন্দর আচরণ করা একটি ইবাদত। রমযান মাসে মানুষের প্রতি সুন্দর আচরণের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দেয়ার পরিবেশ সৃষ্টি হয়। রাসুল সা. বলেছেন, “যদি তোমাকে কেউ গালি দেয় কিংবা তোমার সঙ্গে ঝগড়া করে তাহলে তুমি বলো, যে আমি রোযাদার” (সহিহ বুখারি, ১৮৯৪)। এর মানে হলো তুমি তার মত কটু কথা বলো না। নিজেকে কটুভাষী হিসেবে উপস্থাপিত করো না। সংযত হয়ে বলো আমি রোযাদার। অনাকাঙ্খিত একটি আচরণের বিনিময়ে তুমি কাঙ্খিত সুন্দর আচরণ প্রদর্শন করো। তার মানে-কেউ খারাপ আচরণ করলেও তার জবাব ভাল দিয়েই দিতে হবে, এটাই রোযার শিক্ষা। যা সারা বছর জারি রাখতে হবে।
দশ. সময়ানুবর্তিতা:
রমযানের পুরো একটি মাস ধরে বাৎসরিক সকল ইবাদত সঠিক সময়ে আদায়ের পাশাপাশি অতিরিক্তভাবে নির্দিষ্ট সময়ে সাহরি এবং নির্দিষ্ট সময়ে ঘরির কাটা ধরে মুসলমানেরা ইফতার করে আসছে। ইফতারের নির্ধারিত সময়ের এক মূহুর্ত আগেও কেউ ইফতার করে না, সাহরির নির্ধারিত সময়ের এক মূহুর্ত পরেও কেউ সাহরি খায় না। জঠর জ্বালায় প্রাণ ওষ্ঠাগত তবুও এ নিয়মের ব্যত্যয় কেউ ঘটায় না। এতো কঠিন কাজ যে ব্যক্তি একটি মাস ধরে পুরোপরি করতে পারে সে কি বছরের বাকি সময়গুলোতে এমনটি না হলেও অন্ততঃ সামান্য একটু কম-বেশি করে এর বাস্তবায়ন করতে পারবে না? নিশ্চিয় পারার কথা। কিন্তু আমরা রমযানকে রেখেছি রমযানের জায়গায় আর বছরের অন্যান্য কাজকে রেখেছি তার জায়গায়, এটাই আমাদের বড় সমস্যা। রমযানের নেওয়া প্রশিক্ষণ আমরা ওখানেই ফেলে এসেছি।তাই তো আমরা রমযানের আগে যেমন ছিলাম রমযানের পরে তেমনি রই। আমদের আমলি জিন্দেগীতে কোনো পরিবর্তন সূচিত হয় না।
রোযার এ শিক্ষাগুলোকে যদি আমরা আমাদের বাস্তব জীবনে প্রতিফলন ঘটাতে পারি তাহলে তা হলে ঝঞ্ঝা বিক্ষুব্ধ এ পৃথিবীতে জান্নাতি আবোহ বিরাজ করবে।
লেখক
কলেজ শিক্ষক; সভাপতি, প্রত্যাশা সাহিত্য সাংস্কৃতিক সংসদ ও বাংলাদেশ সাহিত্য ছাউনি
(drazzak77@gmail.com)