২৫ অগাস্ট, ২০২৪ ১৭:১২ পি এম
উত্তাল তরঙ্গ ভেঙে জাগিয়েছে স্বপ্নভাসা তীর
তাওহীদী বন্দরে আজ লাখো নাবিকের ভিড়
২০০২ বা ২০০৩ সালে এ স্লোগান যখন দেয়ালে দেয়ালে দেখতাম তখন পুলকিত হতাম আর স্বপ্ন দেখতাম। অনেকের কাছে জানতে চেয়েছিলাম এ স্বপ্নবাজ পংক্তির স্রষ্টা কে? দুর্ভাগ্যক্রমে সবাই আমাকে ভুল তথ্য দিয়েছিলেন। সঠিক তথ্য জানতে আমার বিশ বছর সময় লেগে গেছে। সম্পূর্ণ ব্যর্থতা মেনে নিয়েই এ কবিকে স্যালুট ও শ্রদ্ধা। তিনি আমার ভেতরে কুরআনের মর্মবাণী কবিতার মাধ্যমে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছেন। সূরা নাসর এ বর্ণিত ঘটনার এমন হৃদয়গ্রাহি বাংলা উচ্চারণ আমাকে মোহের অতল তলে নিয়ে গিয়েছিলো। এই স্বাপ্নিক কবির নাম মোশাররফ হোসেন খান।
তার লেখনীর প্রথম প্রেমে পড়েছি অন্য কারনে। সেটি ছিলো ‘সাগর ভাঙার দিন’ উপন্যাস। বেড়ে ওঠার সময়টাকে রাঙিয়ে দিয়েছিলো এ উপন্যাস। যৌন সুড়সুড়ি মুক্ত এমন গতিময় উপন্যাস আমার প্রথম পড়া। আমার দৃষ্টিতে বাংলা সাহিত্যের সবচেয়ে সফল ছোট উপন্যাস এটি। বাংলাদেশের মানুষের সংস্কৃতি নিয়ে এ দেশে সাহিত্য খুব কম রচিত হয়েছে। অধিকাংশ লোকজনই পশ্চিমবঙ্গের সংস্কৃতিকে বাংলাদেশের সংস্কৃতি বানানোর প্রত্যয়ে উপন্যাস লিখেছেন। তারা আসলে বিকৃত এবং বিক্রিত। এর বাইরে যারা বাংলাদেশকে নিয়ে উপন্যাস লিখেছেন তাদের সংখ্যা খুব নগণ্য। এই নগণ্য ব্যক্তিদের অনেকে আবার জঘণ্যভাবে স্বৈরাচারি মতবাদে সমর্থিত। এসবের বাইরে গিয়ে বাংলাদেশের মানুষের সংস্কৃতিকে প্রামাণ্য চিত্রের মতো করে উপস্থাপন করা হয়েছে এ উপন্যাসে। একদিকে কাহিনীর পরম্পরা, অন্যদিকে বিষয়ের গভীরতা, ভাষার তেজস্বি, চিন্তার প্রাখর্য আর সাহিত্যতত্ত্বের নিঃখুত প্রয়োগ। একজন পাঠককে জোর করে টেনে নিয়ে যায় বাংলাদেশের মানুষের জীবন যাত্রার জীবন্ত আখ্যানে।
তিনি যখন ‘সাহসী মানুষের গল্প’ লেখেন তখন মনে হয় আমি নিজ চোখে সে সাহসীদের দেখতে পাচ্ছি। মনে হয় আমি সেই সাহসী মানুষ। আবার মনে হয় আমি তার মতো হবার সংকল্প আজই গ্রহণ করলাম। পাঠককে উন্মাতাল করে তোলার প্রচণ্ড শক্তি নিয়ে এ লেখকের আবির্ভাব। উনার উপন্যাস আর প্রবন্ধে যখন বিভোর তখন কবি ফজলুল হক তুহিন আমাকে ভিন্ন জগতের সন্ধান দিলেন। তিনি বললেন, আপনি উনার কবিতা পড়ে দেখেন তাহলে আরও বেশি প্রেমে পড়বেন। যথাযথ উপলব্ধি তুহিন ভাইয়ের। শুরু করলাম কবিতা পড়া। কবিতা সমগ্র প্রথম খণ্ড পড়েই বিরল বাতাসের টানে বেঁহুশ হবার মতো অবস্থা। মগ্নতা আর মুগ্ধতায় দোল খেতে থাকি। বাংলা সাহিত্যের ছাত্র হিসেবে সারাবছর জীবনানন্দ দাশের উপমার সৌকর্যে বিমোহিত আমি। সবাই যখন উপমা বলতেই জীবনান্দকে বোঝাতে চান তখন কবি ও সমালোচক আব্দুল মান্নাস সৈয়দ ভিন্ন কথা বলেন। তিনি কাজী নজরুল ইসলামকে উপমার সর্বোচ্চ কৃতিত্ব দিয়ে দেন। এরপরই জীবনানন্দ দাশের প্রসঙ্গ আসে। সৈয়দ আলী আহসানের নাম ভাস্বর হয়ে ওঠে। আল মাহমুদও এ জায়গায় বেশ জোরেশোরে উচ্চারিত কবি। আমি যখন মোশাররফ হোসেন খানের কবিতা পড়তে শুরু করলাম তখন আমার মনে হলো বাংলা সাহিত্যে উপমার এত বৈচিত্র্য আর কেউ দেখাতে পারেননি।
যা কিছু আমার ভাবনার মধ্যে পড়ে না তাই তিনি নিয়ে আসেন। যেমন প্রবাহকে তিনি দাঁতালের সঙ্গে তুলনা করেছেন। প্রলয় হয়েছে পাষাণী, সময় হয়েছে অগ্নিময় পাথর, জ্যোৎস্না হয় সিল্কের পর্দার মতো, কাফন হয় তন্দ্রার, সময় হয় সাদা বরফের মতো। জিহবারও সড়ক থাকে। সে সড়ক বেয়ে হেঁটে যায় সময়। কালেরও পিঠ থাকে। তাও আবার কুটিল। এমন ভাবনা চিন্তার জগতকে ভিন্নমুখি করে তোলে। আমার কাছে মনে হয়েছে বাংলা কবিতায় সবচেয়ে বেশি উপমা ব্যবহার করেছেন কবি মোশাররফ হোসেন খান। এত উপমার ব্যবহার যেমন কাব্যকে গভীর করে তুলেছে তেমনি কবিতা বুঝতে পাঠককে অতিমাত্রায় সচেতন করে তুলেছে। সহজ হতে হতেও কবিতা দুর্বোধ্য হয়ে ওঠে। আবার দুর্বোধ্য হতে হতে সহজ হয়ে যায়। শব্দালঙ্কার আর অর্থালঙ্কারের সূনিপুন প্রয়োগ কবিতাকে নিয়ে গেছে চতুর্মুখি ভাবনার দোলাচলে। বহু সময় ধরে একটি কবিতা বুঝতে হয়। যতবার পড়ি ততবারই নতুন নতুন মনে হয়। প্রথমে সরল অর্থে বুঝলে একটু পরেই দেখি জটিল অর্থ। আবার পড়তে গেলে রূপক এসে ভাবায়। সর্বশেষ দার্শনিকতায় এসে মুক্তি মিলে। দারুণ মিথস্ক্রিয়া।
আশির দশকে বাংলা সাহিত্যে নতুন জাগরণী মন্ত্রের উদ্ভাবক কবিদের মধ্যে তিনি অগ্রগণ্য। বাংলা সাহিত্যকে কলকাতা থেকে ছিনিয়ে এনে ঢাকায় যারা রাজধানী প্রবর্তন করতে চেয়েছিলেন কবি আল মাহমুদ তাদের কাণ্ডারি। মোশাররফ হোসেন খান সে পথের সফল যোদ্ধা। ভাবের বিহারে, শব্দের নতুনত্বে, বিষয়ের বিন্যাসে, কল্পনার অবারিত রাজ্যে, নতুন স্বপ্নের মোহনায় পাঠককে ব্যতিব্যস্ত করে তোলার প্রলয়ঙ্করি শক্তি রয়েছে এ কবির। নিজেকে খুব তুচ্ছ ও ছোট মনে করেন কবি। সারাক্ষণ পরীক্ষা-নীরিক্ষা করেন নিজেকে নিয়ে। শিশুর সারল্য, জ্ঞানীর ভারিত্ব আর দার্শনিকের মৌনতা তাকে করে তুলেছে অনবদ্য। কবিতাকে নিয়ে গেছেন কিংবদন্তির পর্যায়ে। বাংলা কবিতায় বিশ্বাসের ভিত যখন আলোচিত হবে, যখন আদর্শের জয়গাথা নিয়ে গবেষণা হবে, যখন স্রষ্টা ও সৃষ্টিতত্ত্ব নিয়ে বিতর্ক হবে তখন মোশাররফ হোসেন খান প্রাসঙ্গিক হয়ে উঠবেন। বিশেষ করে বাংলা কবিতায় আশির দশকের বাঁক বদল প্রসঙ্গ যখন আসবে তখন সবার আগে উচ্চারিত হবে এ কবির নাম।
তাঁর ২০০২ সালে দেখা স্বপ্ন ২০২৪ সালে এসে সফল হয়েছে। ২০২৪ সালের আগস্টের ৫ তারিখ উত্তাল তরঙ্গ ভেঙে স্বপ্নভাসা তীর ভেসে উঠেছে। বেদনার বিষাক্ত সমুদ্রে সত্য ও সুন্দরের চর জেগেছে। সেই চরে লাখো নাবিক এখন ভিড় করছে। বন্যাদুর্গত মানুষের জন্য টিএসসি হয়ে উঠেছে স্বপ্নের বন্দর। যে তারুণ্যকে তিনি স্বপ দেখিয়েছেন সে তারুণ্য আজ তার স্বপ্নের সোনালি স্বদেশকে নতুন করে নির্মাণ করছে। পরাজিত দেশদ্রোহীরা দেশ ছেড়ে পালিয়েছে। প্রতি বিপ্লবের বহু নীল নকশা তৈরি করেছে। সব ষড়যন্ত্রের ভিতকে পঙ্গু করে দিয়েছে উত্তাল তরঙ্গ ভাঙা শিক্ষার্থীরা।
তাদের সামনে এখন নতুনের হাতছানি। নোনা পানি কেটে কেটে প্রচণ্ড ঝড়ো হাওয়া অতিক্রম করে তাদের স্বর্ণালি জাহাজ নোঙর করেছে বন্দরে। সে বন্দরে অনেক বাধা, অনেক বিপত্তি আসবে। কিন্তু পিছু হটা যাবে না। সামনে যখন চলে এসেছে, বুক পেতে যখন বুলেট নিয়েছে, হৃদপিন্ড যখন ঝাঁঝরা হয়েছে তখন পেছনে ফেরার রাস্তা তারাই বন্ধ করে দিয়েছে। সামনেই বিজয়ের চূড়ান্ত মনযিল। কবি সেই রূপরেখাও তরুণদের দিয়ে রেখেছেন ১৯৯৫ সালে ‘প্রতিকুল’ কবিতায়। সেই রূপরেখা ধরে হাঁটলে বিজয়ের অমোঘ নিশান স্থায়িত্ব লাভ করবে। মানুষ তখন দলে দলে ভিড়বে সুন্দরের সম্মোহনে। তখন কবির কবিতাই হোক তরুণদের সাধনা-
বাতাস দু’ভাগ করে চলেছি দুরন্ত নক্ষত্রের ঘোড়া
কেটেছি দু’হাতে সহস্র আঁধার, তীব্র অমানিশা
আমি তো পালাতে জানি না
ভাঙনই আরাধ্য আমার, আতীব্র তৃষ্ণার পানি
পেছনে ফেরার জন্য
আমি কোনো দরোজা রাখিনি।
আজ (২৪ আগস্ট) কবির জন্মদিবস। শুভ জন্মদিন প্রিয় কবি, প্রিয় রাহবার।