আসাদ বিন হাফিজ বাংলা সাহিত্যের অন্যতম প্রধান কবি। গীতিকার ও শিশু সাহিত্যিক হিসাবেও রয়েছে তার সমধিক পরিচিত। তিনি আদর্শিক দিক দিয়ে ফররুখ আহমদের অনুসারী। তার সাহিত্যে বাংলার মুসলিম সমাজের পুনর্জাগরণ এবং বিপ্লবের অনুপ্রেরণা প্রকাশ পেয়েছে। আধুনিক বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে সৃজনশীলতার পাশাপাশি তিনি সাহিত্যে ইসলামী দৃষ্টিভঙ্গির ব্যবহারেও অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছেন। তিনি ১৯৫৮ সালের ১লা জানুয়ারী গাজীপুর জেলার কালীগঞ্জ থানার অন্তর্গত বড়গাঁও গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। তার পিতা মুহাম্মদ হাফিজউদ্দীন মুন্সী এবং মাতা জুলেখা বেগম। কবি আসাদ বিন হাফিজ ১৯৮০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলা সাহিত্যে স্নাতক (সম্মান) ডিগ্রী অর্জন করেন এবং ১৯৮৩ সালে একই প্রতিষ্ঠান থেকে বাংলা সাহিত্যে মাস্টার্স ডিগ্রী অর্জন করেন।
কবির সাহিত্য রচনার ভাষা অত্যন্ত সহজ-সরল, দুর্বোধ্যতামুক্ত। এ কবির কাব্যসৌধ গড়ে উঠেছে সুবোধ্যতার ভিতের ওপর। কবির শ্রেষ্ঠ রচনা হল ‘অনিবার্য বিপ্লবের ইশতেহার’। এই গ্রন্থে কবিতা ‘অনিবার্য বিপ্লবের ইশতেহার’ কবিতাটি সমগ্র বাংলা সাহিত্যের মধ্যেই একটি অন্যতম সেরা কবিতা। কবিতা, গল্প, প্রবন্ধ, শিশু সাহিত্য, গবেষণা, সম্পাদনা ইত্যাদি সাহিত্যের সব শাখাতেই কবি আসাদ বিন হাফিজ রেখেছেন তার অসামান্য প্রতিভার স্বাক্ষর। এই পর্যন্ত তাঁর আশিটির অধিক গ্রন্থ প্রকাশ পেয়েছে।
কবি আসাদ বিন হাফিজ তার বর্ণাঢ্য কর্ম ও সাহিত্যের স্বীকৃতিস্বরূপ অনেক পুরস্কার ও সম্মাননা পেয়েছেন। ১. কলম সেনা পুরস্কার (১৯৯৪) ২. কোয়ান্টাম ফাউন্ডেশন এম.ইউ আহমেদ পুরস্কার (১৯৯৭) ৩. বাংলাদেশ সাহিত্য সংস্কৃতি সংসদ পুরস্কার (১৯৯৭) ৪. ছড়ার ডাক পদক ও সম্মাননা (২০০৪) ৫. মেলডি শিল্পগোষ্ঠী পদক (২০০৪) ৬. কিশোরকণ্ঠ সাহিত্য পুরস্কার (২০০৪) ৭. গাজীপুর সংস্কৃতি পরিষদ কৃতি সংবর্ধনা (২০০৪) ৮. মরহুম ওমর ফারুক সম্মাননা স্মারক ‘কাব্যরত্ন’-২০১৬ সহ অসংখ্য পুরস্কার ও সম্মাননায় ভূষিত হয়েছেন তিনি। গত ৪ নভেম্বর ২০২২ কবির বাসায় সাহিত্য-সংস্কৃতির নানাবিধ বিষয়ে আমরা মুখোমুখি হয়েছিলাম তার। পাঠকদের জন্য সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেন সম্পাদক মোস্তফা মনোয়ার ও সহকারী সম্পাদক ইয়াসিন মাহমুদ। সাক্ষাৎকারটি চম্বুক অংশ পাঠকদের সামনে তুলে ধরা হলো।
আসসালামু আলাইকুম। কেমন আছেন?
ওয়া আলাইকুমুস সালাম ওয়া রাহমাতুল্লাহ। আলহামদুলিল্লাহ। আল্লাহর রহমতে অনেক ভালো আছি।
আপনার শৈশব ও কৈশোরের স্মৃতি সম্পর্কে যদি কিছু বলেন।
আমার জন্ম এক অজপাড়াগাঁয়ে। অনেকটা গজারী বনের ভেতর। এতদিনে অবশ্য কিছু আম, জাম, লিচু, কাঁঠাল, পেয়ারা ও আনারসের বাগান হয়েছে। নানান বনাজি গাছের সবুজের ভেতর আমার জন্ম। একই গ্রামে মামার বাড়ি হওয়ার পরও মা যখন আমাকে নিয়ে মামাবাড়ি যেতেন, অবাক হয়ে চারদিকে মাঠ বন দেখতাম। মনে হতো পৃথিবীর আরেক প্রান্তে চলে এসেছি। কারণ, বাড়ি থেকে মামাবাড়ির দিকে তাকালে দেখতাম আকাশটা যেন মামাবাড়িতেই নেমে এসেছে। আবার মামাবাড়ি এসে বাড়ির দিকে তাকালে দেখতাম, আকাশ ঠিক আমাদের বাড়িতে চলে গেছে। ভারী অবাক হতাম। সেই বিস্ময়ের ঘোর আজো কাটেনি। আল্লাহর সৃষ্টি জগত যত দেখি ততোই বিস্মিত হই। সেই সাথে বিস্মিত হই, আল্লাহ মানুষকে কত জ্ঞান দিয়েছেন তা চিন্তা করে।
বনবাদাড়ে ঘুরে বেড়ানো এক শিশুর তেমন আর কি স্মৃতি থাকতে পারে। আমরা গাছের তাজা ফল খেয়েই বড় হয়েছি। সপ্তাহে একদিন পাশের গাঁয়ে বাজার বসতো। কটকটি, বাতাসা, তিলের নাড়ু, নাবিস্কো বিস্কিট খাওয়ার কথাও ভুলতে পারি না।
লিখতাম কলাপাতায়। সীমের পাতার রস দিয়ে কালি বানাতেন মা। বাঁশের কঞ্চি কেটে কলম বানাতেন। আব্বা আমাদের জমিতেই মক্তব বানিয়েছিলেন। পাড়ার ছেলেমেয়ে ওখানেই কায়দা পড়ার সবক নিতো।
আজ গাঁয়ে তেমন গজারী গাছ নেই। পাশের গ্রাম ধনপুরে এখনো স্মৃতি হিসাবে টিকে আছে ছোট্ট একটি গজারী বন।
এখন গ্রামেই হাট আছে। আছে মাদ্রাসা, মসজিদ, প্রাইমারী ও হাইস্কুল। আমার পড়ার সূচনা হয় গ্রামে। স্কুলের নাম বড়গাঁও প্রাইমারী স্কুল। যে বকুল গাছের ফুল কুড়ানো ও মালা গাঁথার স্মৃতি এখনো তাড়িত করে স্কুলের পাশের সে গাছটি দেখলাম এখনো বেঁচে আছে, তবে বুড়ো হওয়ায় জৌলুস কমে গেছে।
আগের গ্রাম আর নেই। পাড়ায় পাড়ায় পাকা ঘর, ক্ষেতের আইলের বদলে পাকা রাস্তা, টুংটাং রিক্সার ঘণ্টা। আগে মানুষের মন ছিল পাকা আতাফলের মত নরম, এখন বেল বা কদবেলের মত কঠিন।
আমার ইমিডিয়েট বড় ছিল হাফেজ ইউনুস। নানা মাদ্রাসা ঘুরে শেষে হাফিজি করেন ইছাপুরা মাদ্রাসা থেকে। এটা তালতলা লঞ্চঘাট থেকে কিছুটা পশ্চিমে ইছাপুরা বাজারের কাছে।
ভাইকে আমি খুব ভালোবাসতাম। আমি ভাইয়ের সাথে থাকার বায়না ধরি। হয়তো মা-বাপের ইচ্ছে ও আগ্রহে আমি সেখানে বছর দুই পড়াশোনা করি। আমার নজরানা শেষ হতে হতেই ভাইয়ার হাফেজি শেষ হয়ে যায়। আমরা সেখান থেকে চলে আসি। ভাই ভর্তি হন কুমরাদি মাদ্রাসায়, আমি এক গ্রাম পরে সাওরাইদ স্কুলে। স্কুলটি ছিল শীতলক্ষ্যা নদীর পাশে মনোরম পরিবেশে। রোদ বৃষ্টি মাথায় নিয়ে দেড় মাইল পায়ে হেঁটে স্কুল করতে খুব যে কষ্ট হতো তেমন কোন স্মৃতি নাই। দল বেঁধে হৈ হৈ করে যেতাম আসতাম। মনে হতো জীবন এরকমই।
দাড়িয়াবান্ধা, ডাংগুলি, ঘুড়ি উড়ানো খেলার সেই স্মৃতিময় দিনগুলোতো আর ফিরে পাবো না, বলে কি লাভ।
আপনার পরিবার নিয়ে কিছু বলুন?
না, সোনার চামচ রূপোর চামচের গল্প আমি আপনাদের শোনাতে পারবো না। রবীন্দ্রনাথের মতো জমিদারের ঘরেও আমার জন্ম হয়নি, আবার নজরুলের মত গরীবের ঘরেও না। আমাকে লেটোর দলে গান গেয়ে জীবিকা নির্বাহ করতে হয়নি, রুটির দোকানে কাজ করতে হয়নি আবার পদ্মার বোটে ঘুরে ঘুরে সময় কাটানোর অবকাশও হয়নি। সাদামাটা মধ্যবিত্ত ফ্যামিলি। মায়ের কাছে শুনেছি আমরা দশ ভাই-বোন ছিলাম। পাঁচ ভাই পাঁচ বোন। বোনেরা সবাই বিয়ের আগেই মারা যায়। আমার বড় ইসমাঈল ভাইও শৈশবেই মারা যান। অবশ্য তার তেমন কোন স্মৃতি আমার মনে নেই। টিকেছিলাম আমরা চার ভাই। ইউসুফ আলী, ইদ্রিস আলী, ইউনুস আলী ও আসাদুল্লাহ। লেখক নাম আসাদ বিন হাফিজ গ্রহণ করার পর একসময় কোর্টে যেয়ে নাম পরিবর্তন করতে হয়। এখন জাতীয় পরিচয়পত্রে আসাদ বিন হাফিজ নামই বহাল আছে।
আমাদের ভাইদের মধ্যে আমি যেমন বয়সে ছোট তেমনি প্রতিভায়ও। আমাদের আব্বা ছিলেন অনন্য মেধাবী মানুষ। ছেলেদের ব্যাপারে তার চিন্তা আমাকে অবাক করে। তিনি আমাদের সবাইকে প্রথমে আরবী লাইনে পড়ান, পরে স্কুল, কলেজ, ভার্সিটি। বড় ভাই হাই মাদ্রাসা পাশ। পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তান মিলে যখন এক দেশ এক বোর্ড তখন তিনি ইন্টারমিডিয়েটে অল পাকিস্তানে থার্ড হন। ইদ্রিস ভাইও বরাবর মেধাবী ছিলেন ও স্ট্যান্ড করেন, হাফেজ ইউনুস ভাই মাদ্রাসা বোর্ডে দাখিলে সেকেন্ড হন। আমি অভাগা মাস্টার্সে কোনমতে আঠারোতম লাভ করি।
পরিবার সম্পর্কে যদি বলতেই হয়, বড় ভাই দিয়েই শুরু করতে হয়। ছাত্রজীবন শেষ করার পর পাক সরকার তাকে কেন্দ্রীয় সরকারে চাকরী দিয়ে টিকেট পাঠায়। কিন্তু তিনি তাতে জয়েন না করে অধ্যাপনা শুরু করেন। নরসিংদী কলেজে ইকোনোমিক্সের প্রধান ছাড়াও জামালপুর কলেজ ও আরো যেন কোথায় কোথায় অধ্যাপনা করেন।
১৯৭০ সালের কথা বলি। তখন পার্লামেন্ট ছিল দ্বিকক্ষ বিশিষ্ট। জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদ। কালিগঞ্জ ও কাপাসিয়া মিলে ছিল জাতীয় পরিষদের এক আসন। কাপাসিয়া থেকে দাঁড়ালেন বাংলাদেশের প্রথম প্রধানমন্ত্রী জনাব তাজউদ্দিন আহমদ আর কালিগঞ্জ থেকে দাঁড়ালেন অধ্যাপক ইউসুফ আলী। নির্বাচনে জনাব তাজউদ্দিন আহমদ বিজয়ী হন আর তার নিকটতম প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন অধ্যাপক ইউসুফ আলী।
ব্যক্তিগতভাবে তিনি এত অমায়িক ছিলেন যে, দলমত নির্বিশেষে অনেকেই ছিলেন তার ভক্ত। এলাকার মানুষের অনুরোধে এবং দলীয় সিদ্ধান্তের কারণে বাংলাদেশেও একাধিকবার তাকে এমপি ইলেকশন করতে হয়। মজার ব্যাপার হলো, কখনোই তিনি নিজের এলাকায় পরাজিত হননি।
একাত্তরের যুদ্ধের সময় আমরা এক বেদনাদায়ক অভিজ্ঞতার সম্মুখীন হই। হাফেজ মুহাম্মদ ইউনুস শহীদ হয়ে যান। তিনিও বিয়ের আগেই মারা যাওয়ায় তার আর কোন বংশধর রইলো না।
রইলাম আমরা তিন ভাই। আমাদের আছে প্রচুর নাতিপুতি। নাতির সংখ্যাই অর্ধশতাধিক।
বড় ভাই হার্টএটাক করে মারা যান ২০০৩-এ। সেই থেকে আছি দু’ভাই। এবার ইদ্রিস ভাইয়ের কথা বলি। তিনি সর্বশেষ কুমিল্লা টিচার্স ট্রেনিং কলেজের প্রিন্সিপাল থেকে রিটায়ার্ড করেন। একজন খ্যাতিমান শিক্ষাবিদ হিসাবে সরকারী খরচে বিভিন্ন দেশ সফর করেন।
আপনার প্রিয় শিক্ষকদের সম্পর্কে যদি কিছু বলেন?
প্রিয় শিক্ষকদের সবার নাম এখন মনে নাই। তবে গ্রামের স্কুলে সবচে প্রিয় শিক্ষক ছিলেন “পড় পড়” স্যার। তিনি একটি বেত নিয়ে ক্লাশে ঢুকতেন আর টেবিলে একটা যুৎসই বাড়ি দিয়ে বলতেন, এই, চুপ। সবাই বসে মনে মনে পড়। তারপর তিনি টেবিলে মাথা রেখে ঘুমিয়ে যেতেন। কিন্তু ঘণ্টা পড়লে ঠিকই টের পেতেন এবং উঠে বেত হাতে টিচার্স রুমে চলে যেতেন। আমরা সবাই তখন বকুল তলায় বকুল ফুল টোকাচ্ছি। ফোরকানিয়াতে নূরী হাজী ও নূরুল হক মুন্সী দুজনই আমার প্রিয় ছিল।
এরপর স্মৃতিময় স্কুল ছিল সাওরাইদ হাইস্কুল। যদিও আমি পড়তাম প্রাইমারী সেকশনে।
যারা অলি পণ্ডিত স্যারকে পেয়েছেন তারা কখনো তাকে ভুলতে পারবেন না। তিনি টিচার্স রুম থেকে বেরুলে সারা স্কুল নিমিষে ঠাণ্ডা। তাকে যেমন যমের মতো ভয় করতাম, তেমনি ভালোও বাসতাম। তিনি কি আমাদের খুব আদর করতেন? জানি না, তবে শিক্ষক শব্দটা শুনলে সবার আগে তার কথাই মনে পড়ে।
মনে পড়ে আরজু স্যারের কথা। পরীক্ষা দিচ্ছি। কিছুতেই মনে করতে পারছি না রেডিও কে আবিষ্কার করেন। পাশ দিয়ে টহল দিচ্ছিলেন আরজু স্যার। দাঁড়ালাম। স্যার ভাবলেন, প্রশ্ন বুঝতে পারছি না। এগিয়ে এলেন। বললাম, স্যার, রেডিও কে আবিষ্কার করেন?
স্যার বললেন, মারবো কুনি, বস লেখ। সাথে সাথে মনে পড়ে গেল। লিখলাম, মার্কনি।
নরসিংদীর ব্রাহ্মন্দী হাইস্কুল, তেজগাঁও পলিটেকনিক হাইস্কুল, ফরিদাবাদ হাইস্কুল এরকম নানা স্কুল মাড়িয়ে এসএসসি পাশ করি।
কোথায় ভর্তি হবো ভাবছি। এসময় বড় ভাইয়ের বন্ধু অধ্যাপক নাজির আহমদ, মাওলানা মুসলেমউদ্দিন এরা টাঙ্গাইলের আলাউদ্দিন সিদ্দিকী কলেজে অধ্যাপনা করতেন। ভাই তাদের সাথে আলাপ করে আমাকে পাঠিয়ে দিলেন আরেক পাড়াগাঁয়ে। কলেজ থেকে দেখা যেতো বিচারপতি আবু সাঈদ চৌধুরীর বাড়ি, ড. আশরাফ সিদ্দিকীর বাড়ি। কলেজের প্রিন্সিপাল ছিলেন লতিফ সিদ্দিকী, কাদের সিদ্দিকীর ভাই।
১৫ আগস্টের পর কলেজ পরিচালনা কমিটি ও শিক্ষকদের কেউ ভারতে আশ্রয় নেয়, শুনেছি কেউ মধুপুরের গড়ে। কে চালাবে হোস্টেল, কে নেবে ক্লাস কলেজ বন্ধ হয়ে যায়। আমরা আবার ব্যাক টু দ্য প্যাভিলিয়ন।
পড়ালেখা নাই, আমারতো আরামই। কিন্তু পরিবার একটা বছর নষ্ট করতে রাজি না। সবার চেষ্টায় সেকেন্ড ইয়ারে ভর্তি হলাম ঢাকা কলেজে। পেলাম একঝাঁক স্টার স্যার। সবার আগে নাম করতে হয় আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ স্যারের। কৌশিক সম্পাদক কামাল আতাউর রহমান, রওশন আরা ম্যাডামসহ আরো অনেকে।
এরপর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গেলাম। ডিপার্টমেন্টাল চীফ হিসাবে পেলাম ড. কাজী দীন মুহাম্মদকে। শিক্ষক হিসাবে পেলাম ড. রফিকুল ইসলাম, সাঈদ উর রহমান, নরেন বিশ্বাস প্রমুখ স্যারকে। সব জাঁদরেল শিক্ষক।
ওটা ছিল প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষা। কিন্তু লেখকদের শিক্ষক হয় প্রকৃতি। আজো প্রতিনিয়ত পড়ছি প্রকৃতির বিচিত্র বিষয়। প্রজাপতির আল্পনা, পাখির বিচিত্র গড়ন, মাটি ভেদ করে বৃক্ষের উন্মেষ সবই তো দেখার বিষয়, শেখার বিষয়।
আপনার জন্মভূমি, বেড়ে ওঠা শান্ত গ্রাম। যে পাড়া গাঁয়ে বসে বড় হবার স্বপ্ন এঁকেছেন নিজ সেই গ্রাম নিয়ে কিছু বলুন।
গ্রাম সম্পর্কে বলার তেমন কিছুই নেই। বলতে পারেন এক নজরকাড়া সবুজ জাজিম। গ্রামের নাম বড়গাঁও। যেমন নাম তেমনি বড়। একই গ্রামে অনেকগুলো পাড়া। পাড়ার নামও বড় অদ্ভুত। ভূতপাড়া, ভিটিপাড়া, গাজীপাড়া, শেখপাড়া পলানপাড়া, খরাদিপাড়া ফকিরপাড়া, উত্তরপাড়া, পূর্বপাড়া এরকম অসংখ্য পাড়া মিলে বিরাট এক গ্রাম বড়গাঁও। পাড়ায় পাড়ায় মসজিদ। ছাত্রজীবনে একবার সার্ভে করেছিলাম। তখন তেরটা মসজিদ পেয়েছিলাম গ্রামে। গ্রামটা গাজীপুর জেলায়। উপজেলার নাম কালিগঞ্জ। আমাদের ইউনিয়নের নাম মোক্তারপুর। এ ইউনিয়নেই জন্মেছিলেন শহীদ ময়েজউদ্দিন আহমদ। যার কন্যা মেহের আফরোজ চুমকি এখন সংসদ সদস্য। বলতে পারেন আমরা একই ইউনিয়নের অধিবাসী। গ্রাম এখনো শহর হয়নি তবে শহরের নানা সুযোগ সুবিধা এখন গ্রামে বসেই পাওয়া যায়।
লেখালেখিতে কীভাবে এলেন এবং কেন এলেন?
স্কুলে যখন কবি রবি ঠাকুর, কবি নজরুল ইসলাম, সত্যেন্দ্রনাথ দত্ত, কামিনী কুমার, গোলাম মোস্তফা, কায়কোবাদ এদের ছন্দোবদ্ধ কবিতাগুলো পড়তাম তখন মনে হতো, আহ, আমি যদি এমন লিখতে পারতাম! পঞ্চম শ্রেণী পর্যন্ত স্বপ্নটা ধীরে ধীরে পল্লবিত হতে থাকে। ষষ্ঠ শ্রেণীতে পড়ার সময় থেকে ছন্দ মিলাতে শুরু করি।
এসময় গ্রাম ছেড়ে নরসিংদী ও পরে ঢাকায় চলে আসি। থাকতাম মীরহাজীর বাগের কাজী পাড়া বড় ভাইয়ার সাথে। পাশেই গেন্ডারিয়া থেকে কয়েকটি স্থানীয় সাপ্তাহিক পত্রিকা বের হতো। ওসব পত্রিকায় দু’একটা টুকরো কবিতা আসাদুল্লাহ নামে ছাপা হয়। একই মহল্লায় থাকতেন ‘সোনার বাংলা’র সাংবাদিক আলতাফ হোসেন। তিনি প্রথমে ছোটদের পাতা ‘পাতা বাহারে’ দু’একটা ছড়া ছাপেন।
আমি তখন ফরিদাবাদ হাইস্কুলে পড়ি। লোহারপুলের এক পাশে ফরিদাবাদ ও মিলব্যারাক। পুল পেরোলেই সূত্রাপুর, হৃষিকেশ দাস রোড। এই হৃষিকেশ দাস রোড থেকেই বেরোতো ‘সাপ্তাহিক সোনার বাংলা’। ইতিহাসবিদ ও বিশিষ্ট ব্যাংকার মুহাম্মদ আবদুল মান্নান সম্ভবত তখন ‘সোনার বাংলা’ সম্পাদনা করেন। বাড়ি পার্শ্ববর্তী থানা আড়াইহাজারে। বড় ভাইকে চিনতেন। প্রথম পরিচয়েই লিখতে উৎসাহ দেন। আলতাফ হোসেন ও আবদুল মান্নান ভাই পর পর ‘সোনার বাংলা’ য় আমার বেশ কটি ছড়া ছাপেন। তাতে আমার সাহস বেড়ে যায়। বলতে পারেন লেখালেখির সেই শুরু।
সেই বয়সে যা হয়, সমাজের অনাচার, নানা অসঙ্গতি দূর করার একটা সংকল্প প্রায় সব কিশোর মনেই জাগে। আমারও তাই। একটা সুন্দর সমাজ গড়ার স্বপ্ন নিয়ে লেখা শুরু হয়ে গেল। ভাবলাম, দেশ স্বাধীন হয়েছে, এখন আর কাউকে ক্ষুধায় কষ্ট পেতে হবে না। কিন্তু কি দুর্ভাগ্য, বুড়ো হয়ে গেলাম, কত লিখলাম কিন্তু এখন দেখছি, সমাজে বরং আগের চাইতে অনাচার, অবিচার, জুলুম, শোষণ, নষ্টামী বেড়ে এগুলো ক্রমেই প্রাতিষ্ঠানিক রূপ নিচ্ছে। সমাজ পাল্টে দেয়ার যে স্বপ্ন নিয়ে লেখালেখিতে এলাম, তাতে কি সমাজের কোন উপকার হলো?
আপনার প্রথম লেখা প্রকাশের অনুভূতি জানতে চাই।
স্বাভাবিকভাবেই চরম পুলক অনুভব করেছি। ঘনিষ্ঠ বন্ধুদের দেখিয়েছি।
আপনার প্রথম বই প্রকাশের অভিজ্ঞতা যদি একটু শেয়ার করতেন।
আমার প্রথম বই “কি দেখো দাঁড়িয়ে একা সুহাসিনী ভোর (১৯৯০)”। এত বড় নাম কবিতার বইয়ের অনেকেই অপছন্দ করেছে, ছোট ও শ্রুতিমধুর নাম দিতে পরামর্শ দিয়েছে। তাদের কাছে আমি কৃতজ্ঞ, কিন্তু আমার মনে হয়েছে, আমি যা বলতে চাই, এ নামটাই তার জন্য উপযুক্ত। একটা সুহাসিনী ভোর জাতির দরকার। জাতি কি সে ভোর দেখতে পাচ্ছে? এটা একটা প্রশ্ন। আবার সুহাসিনী ভোরকেই আমি জিজ্ঞেস করছি, সে একা দাঁড়িয়ে কি দেখছে? সামনে কি ঘোর অন্ধকার নাকি আশার কোন আলো দেখা যাচ্ছে? জাতি সামনের দিকে তাকিয়ে যা দেখছে ওটাই কি সুহাসিনী ভোর?
এরকম নানাভাবে বিষয়টিকে কল্পনা করা যায়। জাতিকে নতুন ভোরের স্বপ্ন দেখানো যায়। কবির কাজইতো মানুষের মনে স্বপ্ন বুনে দেয়া। আমি সেই সুহাসিনী ভোর জাতিকে উপহার দিতে চেয়েছি।
বই প্রকাশ করার আগে পাণ্ডুলিপি নিয়ে বন্ধুদের সাথে বিস্তর আলাপ করেছি। পরামর্শ নিয়ে কবিতা নির্বাচন করেছি এবং মুরুব্বীদের দোয়া ও পরামর্শ নিয়েছি। পাণ্ডুলিপি কষ্ট করে দেখে দিয়েছেন প্রবীণ কবি আবদুস সাত্তার, নজরুল গবেষক শাহাবুদ্দীন আহমদ এবং বই বেরোনোর পর তারা এর ওপর রিভিউও লিখেছেন। বই বের করার আবেগ দমন করে একটা সুন্দর বই বের করার জন্য যে ধৈর্য ধারণ করা দরকার সম্ভবত সেটা আমি করতে পেরেছি।
আপনি সাহিত্য ও সংস্কৃতিকে কিভাবে সংজ্ঞায়িত করবেন?
এটা একটা কঠিন প্রশ্ন। সংজ্ঞায়িত করার দায়িত্ব সাহিত্য সমালোচকদের। আমার মতে, সাহিত্য সংস্কৃতির দুটো ভাগ আছে। একটা সাহিত্য আরেকটা অপসাহিত্য। একটা সংস্কৃতি অপরটি অপসংস্কৃতি।
যে সাহিত্যকে রবীন্দ্রনাথ প্রয়োজনীয় সাহিত্য বলেছেন সেটাই সাহিত্য। যা অপ্রয়োজনীয় তাই বেহুদা কাজ। বেহুদা কাজ সাহিত্য হয় কি করে? যে সাহিত্য মানুষের মধ্যে স্রষ্টা ও সৃষ্টিপ্রেম জাগাতে পারে সেটাই সাহিত্য। আমাদের দুর্ভাগ্য, দীর্ঘদিন যাবত অপসাহিত্যকেই আমাদের সামনে সাহিত্য হিসাবে পরিবেশন করা হচ্ছে। যে সাহিত্য সংস্কৃতি মানুষকে উন্নত জীবনবোধের দিকে ধাবিত করে না তা সাহিত্য হয় কি করে? মনে রাখবেন, মন্দ সর্বত্রই মন্দ। ইসলাম মদকে হারাম করেছে সে জন্য আপনি মদ পছন্দ করেন না। কিন্তু আপনিই বলুন, একজন খ্রিস্টান বা হিন্দু কি চায় তার সন্তান মদ খেয়ে মাতাল হয়ে বাড়ি ফিরে বৌ পিটাক। মুসলমান খুনকে জঘন্য অপরাধ মনে করে। কোন সভ্য সমাজ বা ধর্ম কি খুনকে মহত কাজ মনে করে? যা জীবনবোধকে কল্যাণের দিকে প্রবাহিত করে না তাই অপসাহিত্য। যে সাহিত্য পড়ে মানুষ পরকীয়া শেখে তাকে আপনি সাহিত্য বলবেন, না অপসাহিত্য বলবেন?
সংস্কৃতি কি? সংস্কারমূলক কীর্তি। যা জীবনকে সুন্দর করে, সাবলীল করে, পরিচ্ছন্ন করে। যে সংস্কৃতি মানুষে মানুষে ঘৃণাবোধ সৃষ্টি করে, হিংসা জাগায়, লোভ বাড়ায় সেটা কি করে সংস্কৃতি হয়। জাতিভেদ, ধর্মভেদ, সাদাকালো, ধনী গরীবে বিদ্বেষ সৃষ্টি করে যে সাহিত্য ও সংস্কৃতি তাই অপসাহিত্য সংস্কৃতি। এটা না ব্যক্তির জন্য কল্যাণ বয়ে আনে, না দল ও গোষ্ঠীর জন্য। এ ধরনের অনাচারকে উসকে দেয় যে সাহিত্য সংস্কৃতি তাকে ‘না’ বলার সাহস অর্জন করার এখনই সময়। আমরা আর অপসাহিত্যকে সাহিত্য বলতে চাই না, অপসংস্কৃতিকে সংস্কৃতি বলতে চাই না। মধু বলে ইতোমধ্যেই আমাদের অনেক বিষ খাওয়ানো হয়েছে, এবার এই অপসাহিত্য ও সংস্কৃতিকে বর্জন করে জীবনকে সুন্দর করার সময় এসেছে।
আশির দশকের কবি ও কবিতা সম্পর্কে সংক্ষেপে যদি কিছু বলেন?
আশির দশকের সূচনালগ্নে বাংলাদেশের একদল তরুণ বাংলা সাহিত্যে এক নতুন অভিযাত্রার সূচনা করে। নতুন মানে, নষ্ট সাহিত্যকে আবার স্বমহিমায় দাঁড় করাবার প্রয়াস পায় তারা। এই মিছিলে শরীক হয় অনেক তরুণ। তারা বেলগাছিয়ার ঝুপড়ি থেকে সাহিত্যকে আবার রাজ দরবারে নিয়ে আসার প্রয়াস পায়। শুরুটা কয়েকজন নবীন কবি করলেও অচিরেই আমাদের প্রবীণ কবিরা এদের দিকে ফিরে তাকায়। এদের শীর্ষে অবস্থান নেন কবি আল মাহমুদ ও কবি আফজাল চৌধুরী। এদিকে চোখ ফেরান কবি আবদুস সাত্তার, সৈয়দ আলী আহসান, আবদুল মান্নান সৈয়দ, আশরাফ সিদ্দিকী, সৈয়দ আলী আশরাফসহ অনেক প্রবীণ কবি। নিঃসঙ্গ পথিকের মত একদিন একাকী যে পথে হাঁটা শুরু করেছিলেন কবি ফররুখ আহমদ এই নবীন কবিরাও সেই পথ ধরলেন এবং তাদেরকে হাততালি দিয়ে স্বাগত জানালেন এইসব প্রবীণ কবিগণ। সাহসের পথ দেখালেন আল মাহমুদ। বাংলা সাহিত্যের ওপর দিয়ে তিনি বখতিয়ারের ঘোড়া ছুটিয়ে দিলেন। বই উৎসর্গ করলেন চার নবীন সহযোদ্ধাকে। এরা হলেন কবি মতিউর রহমান মল্লিক, আসাদ বিন হাফিজ, বুলবুল সরওয়ার ও কবি সোলায়মান আহসানকে। এ কাফেলায় আরো অনেকেই ছিলেন, যেমন, মোশাররফ হোসেন খান, হাসান আলীম, মুকুল চৌধুরী এবং আরো অনেকে। এ ব্যাপারে বিস্তারিত আলোচনা করেছেন কবি হাসান আলীম তার ‘আশির দশক জ্যোতি জোসনার কবিকণ্ঠ’ নামক বইয়ে। দেশপ্রেমিক কবি আবদুল হাই শিকদারেরও পছন্দ হয়ে গেল আমাদের তৎপরতা। তিনিও এসে যোগ দিলেন আমাদের দলে। তার শক্তিশালী হাত এই নবীন কবিদের সাহস যোগালো। এভাবে তিনিও হয়ে গেলেন আমাদের একজন।
এই কবিগোষ্ঠীর মূল কথা ছিল, সাহিত্য থেকে নষ্টামী তাড়াতে হবে। এক সূর্য যেমন বিশ্ব আলোকিত করতে পারে তেমনি এক ইসলামই দুনিয়া থেকে সব অন্যায়, অনাচার দূর করার জন্য যথেষ্ট।
এ শুদ্ধস্বর কাব্যান্দোলনের সেনাপতির দায়িত্ব নিলেন কবি মতিউর রহমান মল্লিক। তাকে ঘিরে যে বলয়টি এর নেতৃত্ব দিলেন তারা হলেন কবি আসাদ বিন হাফিজ, কবি সোলায়মান আহসান, কবি বুলবুল সরওয়ার, কবি মোশাররফ হোসেন খান ও কবি মুকুল চৌধুরী।
আরো এলেন কবি আবদুল হাই শিকদারসহ সারাদেশ থেকে প্রচুর তরুণ কবি সাহিত্যিক। এক বিশাল কবিগোষ্ঠী বাংলা সাহিত্যের নষ্ট ধারা পাল্টে দেয়ার যুগপৎ আন্দোলনে যোগ দেয়ায় ভোগবাদী মাতাল সাহিত্যিকরা খালি মাঠে গোল দেয়ার স্বপ্ন ফেলে পিছু হঠতে শুরু করে। এভাবেই আশির দশককে মূল্যায়ন করা যায়।
বাংলা সাহিত্যে আশির দশক এসে দখিনা হাওয়ার এমন এক পরশ বুলিয়ে দেয় যা জনমনে স্বস্তির শিহরণ বইয়ে দেয়। আজকের তরুণ কবিরা যে সুন্দরের জন্য পাগল, সত্যের জন্য পাগল এভাবেই তা পল্লবিত হয়ে ওঠে। আপনি তরুণ লেখকদের দিকে তাকিয়ে দেখুন। অশ্লীল শব্দ তারা এখন কমই ব্যবহার করে। তারা নিজে ভালো হতে চায়, সন্তানদেরও ভালো মানসিকতায় গড়ে তুলতে চায়। বলতে পারেন এই আকাক্সক্ষার সৃষ্টি করেছে আশির দশক। যে সুবাতাসই এখনো বইছে।
কবি- সাহিত্যিকদেরকে মূল্যায়নের ক্ষেত্রে দশক ওয়ারি বিভাজনকে কিভাকে দেখেন?
ওসব নিয়ে আমি ভাবি না। কেউ দশকওয়ারি বিভাজন করতে চাইলে করুক, না চাইলে না করুক। আমার লেখা মানুষের হৃদয়ে জায়গা করে নিতে পারলো কিনা সেটাই আমার বিবেচ্য। আল্লাহ যেন আমাকে খ্যাতির কাঙাল না বানায়। আল্লাহর গোলাম বলে তাঁর সৃষ্টির কল্যাণের জন্য কাজ করা আমার দায়িত্ব মনে করে লিখি। আল্লাহ যেন আমার লেখা আমার নাজাতের উসিলা বানায়।
আপনার রচিত ‘অনিবার্য বিপ্লবের ইশতেহার’কবিতাটি মানুষের মুখে মুখে শোনা যায় এবং বিভিন্ন মঞ্চে অসংখ্যবার আবৃত্তি হয়েছে এ কবিতাটি। এ ব্যাপারে আপনার অনুভূতি জানতে চাই। আর এ কবিতাটি কোন প্রেক্ষাপটে লিখেছেন যদি বলতেন।
এর ইতিহাস বড় অদ্ভুত। একটি সম্মেলন উপলক্ষে একটা স্মারক বেরোবে। একটা উদ্দীপনামূলক কবিতা দিতে হবে। কবিতাতো আর আসে না। তখন ঘণ্টাভিত্তিক রিক্সা ভাড়া পাওয়া যেতো। সেভাবেই রিক্সা ভাড়া নিলাম। তখন মোবাইলের যুগ ছিল না। চলতি রিক্সায় হিজিবিজি লিখতাম। স্মৃতি আর লেখা এক করে কোথাও বসে টুকে নিতাম। কি বলবো ভাবতাম আর আল্লাহর সাহায্য চাইতাম। ক্রমাগত সপ্তাহখানেক গেলো এভাবে। এরপর ফ্রেস করলাম। এ কবিতা বলতে পারেন পুরোটাই এলহাম। এতে আমার কোনো হাত নাই। আমার ছিল শুধু একাগ্রতা। এই কবিতার লক্ষ লক্ষ পাঠক, শ্রোতা সবই আল্লাহর দান। আমি জানতাম না, একটা কবিতা এতটা জনপ্রিয় হয়ে উঠবে।
লেখকরা অনেকের কাছ থেকেই উৎসাহ পায়। ফলে তাদের লেখার গতি ও পরিধি বিস্তৃত হয়। আপনাকে উৎসাহ যুগিয়েছে এমন দুএক জনের নাম বলবেন?
কথা প্রসঙ্গে আলতাফ হোসেন ও মোহাম্মদ আবদুল মান্নানের নাম তো আগেই বলেছি। লেখালেখির জীবন যেমন লম্বা তেমন উৎসাহ দাতার পরিমাণও বিশাল। এক সাক্ষাৎকারে কয়জনের নাম বলা যায়?
শিশুদের জন্য লেখা আমার প্রিয় সাবজেক্ট। ‘বর্ণমালার ছড়া’ নামে আমার একটি বই বেরিয়েছে। একজন ভালো শিল্পী এর ইলাস্ট্রেশন করুক এটা মনে মনে চাইতাম। ইলাস্ট্রেশনের প্রশ্ন এলে যে লোকটি আগ্রহ করে এ দায়িত্ব নেন তার নাম মাহবুবুল হক। তিনি শিল্পী সবিহ উল আলমকে দিয়ে কাজটি করিয়ে দেন। মাহবুবুল হক এক আকাশ হৃদয় মানুষ। তার ভালোবাসার মানুষের সংখ্যাও অনেক। এদের তালিকা গুনে শেষ করা যাবে না। কত লেখককে যে তিনি নানাভাবে হেল্প করেছেন তার তালিকাও অনেক। প্রবীণ থেকে তরুণ, তরুণ থেকে নবীন আজকের খ্যাতিমান অনেকেই মুখ ফুটে না বললেও মনে মনে অহরহ তার জন্য অন্তর থেকে দোয়া করেন। তাঁর স্নেহ ও ভালোবাসা আমাকে নিবিড়ভাবে সাহস যুগিয়েছে।
আমার লেখক হয়ে বেড়ে ওঠার পেছনে নেপথ্যে ভূমিকা রেখেছে কিশোরকণ্ঠ। এর সূচনা করেছিলেন ড. আ জ ম ওবায়েদুল্লাহ। প্রতি সংখ্যায় আমার নির্দিষ্ট লেখা তো যেতোই নবীন লেখকদের লেখাও আমাকে সম্পাদনা করতে হতো। ওবায়েদ ভাইয়ের কথা ছিল মফস্বল থেকে যে কিশোরটি লেখা পাঠাবে তার নামটি যেন ছাপা অক্ষরে সে দেখতে পায়। দরকার হলে নামটা ও বিষয় ঠিক রেখে চার লাইনের একটি ছড়া নতুন করে লিখে তার নামে দিয়ে দেবেন। মাসের পর মাস এ কাজ করতে গিয়ে যে পরিপক্কতা অর্জন করেছি, সে কৃতিত্ব ওবায়েদ ভাইয়ের। শুধু তাই নয়, তিনি যখন ‘অঙ্গীকার ডাইজেস্ট’ বের করেন তখন ভাষা আন্দোলনে কমিউনিস্ট পার্টির ভূমিকা বিষয়ে একটি প্রবন্ধ লিখতে বলেন। তিনি আমাকে তিন মাস সময় দেন এবং মোটা অংকের সম্মানীর লোভ দেখান। যথাসময়ে সে লেখা প্রকাশিত হয় এবং আমিও উৎসাহব্যঞ্জক সম্মানী পাই। আজকের ভাষা আন্দোলনের ইতিহাস সে প্রবন্ধেই ফসল।
মল্লিক ভাই তখন ‘সোনার বাংলা’র সাহিত্য সম্পাদক। আমাকে বললেন, প্রতি সংখ্যায় লেখা চাই। বললাম, তা কি করে সম্ভব? তিনি বললেন, গেল সংখ্যার আলোচনা নামে একটা লেখা প্রতি সংখ্যায় আপনি দিবেন। তাতে আমরা কি চাই লেখকরা বুঝতে পারবে, গাইডেন্স পাবে। অন্য উপদেশ দেয়ার মধ্য দিয়েও যে শেখা যায় তা আমি বুঝতে পারি এ আলোচনায়। বুঝলাম, সম্পাদকরাই লেখক তৈরী করে। যত ভালো বাঁধুনী হবে তত ভালো রান্না হবে। কমিটেড সম্পাদকরাই কমিটেড লেখক তৈরী করে।
আপনার লেখা কোন কোন গান আপনাকে বেশি উচ্ছ্বসিত ও আন্দোলিত করে?
কবি মতিউর রহমান মল্লিক ভাই জোর করে সাইমুমের দায়িত্ব আমার কাঁধে তুলে দেন। তখনো আমি গান লিখিনি। আমি গান গাইতেও জানি না, সুরও দিতে জানি না। পরিচালনা পরিষদের সিদ্ধান্তে তখন আমার আর করার কিছুই ছিলো না। মল্লিক ভাই বললেন, গান নিয়ে আপনার ভাবতে হবে না, ওটা আমি দেখবো। আপনি শুধু হাল ধরে রাখবেন।
আমি তাই করলাম। মল্লিক ভাই বেঁচে থাকতে আমি তেমন গান লিখিওনি। তার মৃত্যুর পর কারো বলা লাগলো না, নিজেই দায়িত্ব তুলে নিলাম। শুরু করে দিলাম লেখা। এখনতো আমার গানের প্রায় হাজারের কাছাকাছি।
আমার সব গানইতো আমার সন্তানের মতো। কোনটা শ্রোতারা পছন্দ করবে কিংবা করবে না সেটা দর্শক-শ্রোতার হাতে ছেড়ে দেয়াই ভালো। দর্শকরাই বলুক কার কোনটা ভালো লাগে। আমি এই ফাঁকে আরো কিছু গান লিখি।
ইসলামী সাহিত্য ও অনইসলামী সাহিত্যের পার্থক্যটা করবেন কিভাবে?
ইসলাম ভালো, মঙ্গল ও কল্যাণের পক্ষে। যেখানে এসব আছে সেটাই ইসলামী সাহিত্য। আর যেটা ইসলামী সাহিত্য সেটাই সাহিত্য। সুন্দরের বিপক্ষে যে সাহিত্য সেটাই অনইসলামী বা অপসাহিত্য।
এখানে একটা কথা বলা দরকার। আজকাল মানবতা ও মানবিক শব্দদুটো খুব খাচ্ছে। কথায় কথায় বলা হচ্ছে মানবিক সাহিত্য। আমি বলবো, সাহিত্য হবে সার্বজনীন। যে সাহিত্য পড়লে পাখির প্রতিও আপনার মমত্ববোধ জাগবে, প্রাণীর প্রতি, প্রকৃতির প্রতিও। একটি সমন্বিত ভালোবাসা ছাড়া পৃথিবী চলে না। প্রতিটি বস্তু, প্রতিটি প্রাণীর অধিকার আছে আপনার ভালোবাসা পাওয়ার। কারণ সে আপনাকে ভালোবাসা দেয়। ভালোবাসার বিনিময় শুধু ভালোবাসাই হতে পারে। গাছ ভালোবেসে অক্সিজেন না দিলে আপনি বাঁচবেন না। আপনি কি তার প্রতিদান দেবেন না? আপনি প্রজাপতি ভালোবাসলে ফুলকেও ভালোবাসতে হবে। কারণ ফুল না পেলে প্রজাপতি কাকে আদর করবে।
হযরত ওমর (রা.) বলতেন, ফোরাতের কুলে একটি কুকুরও না খেয়ে মরলে আমি ওমরকে জবাবদিহি করতে হবে।
রাসূল (সা.) বলেছেন, তুমি যদি জানো একটু পর কেয়ামত হবে, তারপরও সুযোগ থাকলে একটা গাছ লাগাও। মানবতা ও মানবিকতা খুবই একপেশে ও সংকীর্ণ দৃষ্টিভঙ্গি। মুসলমান আল্লাহর খলিফা। অতএব তার কাজ সমগ্র সৃষ্টিকুলের ভালো-মন্দ দেখা। ক্ষুদ্রতা থেকে বৃহত্তর পরিমণ্ডলে আসুন। মানুষ না হয়ে মুসলমান হোন। মানবিক না হয়ে ইসলামিক হোন। মানবতা শুধু মানুষকে ধারণ করে কিন্তু ইসলাম সারা বিশ্বজগতকে ধারণ করে। আপনি কেন জেনে শুনে সংকীর্ণমনা হবেন?
অতএব সাহিত্য মানেই ইসলামী সাহিত্য আর ইসলামহীন সাহিত্য হচ্ছে অপসাহিত্য। আপনি বলুন, আমরা সাহিত্য করি। মার্কসিস্টরা বলুক তারা মার্কসীয় সাহিত্য করে। যারা যে খণ্ডের জন্য সাহিত্য করে তারা তার কথা বলুক। আমরা কেবল মুসলমানের জন্য সাহিত্য করি না, সাহিত্য করি স্রষ্টা ও সৃষ্টি জগতের সব কিছুর জন্য। আমরা মানুষের সাথে মিতালি করতে চাই, পাখির সাথে মিতালি করতে চাই, নদী আমাদের আপন, বন-বনানী আমাদের স্বজন। যে শস্যদানা আমাকে আহার যোগায় আমি তাকে ভালোবাসি, যে মাছগুলো আমাদের জন্য অপেক্ষা করছে তাদেরকে ভালোবাসি। না বিদ্বেষ, না ঘৃণা, না অবজ্ঞা অবহেলা। যেদিন কেয়ামত হবে সেদিন পাহাড় তুলোর মতো উড়বে, সব ধ্বংস হয়ে যাবে, এর আগ পর্যন্ত আমরা মিলেমিশে থাকবো। আমাদের প্রভু বলেছেন, সব তিনি সৃষ্টি করেছেন আমাদের ভোগের জন্য, কুক্ষিগত করার জন্য নয়। যার খাবার তারে দেন, নিজের খাবার নিজে খান। যা জমাবেন তাই ক্ষতি। সে আপনার কোন কাজেই আসবে না। উদার হোন, মহত হোন। এই ছিল আমাদের নবীর দাওয়াত। তিনি সবকিছু করেছেন, আপনিও করুন। আপনি মেঘকে ভালোবাসবেন, মেঘ আপনাকে বৃষ্টি দেবে। ইসলাম এই সামগ্রিক ভালোবাসার নাম। মানবতা মানবতা বলে ভণ্ডামী ছাড়ুন। বলুন, ইসলাম ইসলাম ইসলামই মানুষের মুক্তির ঠিকানা। ইসলামই সভ্যতা। ইসলাম মেনে চললে কেউ ঠকে না। কারণ ইসলাম কেউ বানায়নি। যিনি আপনাকে বানিয়েছেন ইসলাম তিনিই পাঠিয়েছেন। সমস্ত সৃষ্টি জগত ইসলাম মানে। ইসলাম মানে বলেই চাঁদ জোসনা দেয়, সূর্য আলো দেয়। পানি নিচের দিকে প্রবাহিত হয়। এটাই ধর্ম, এটাই ইসলাম। ইসলাম কোন দল, গোষ্ঠী, জাতির জন্য আসেনি। সবার ধর্ম স্রষ্টা নির্ধারণ করে দিয়েছেন। যে মানে না সে কষ্ট পায়। যেমন মানুষ। ইচ্ছে হলে মানে, ইচ্ছে হলে স্বাধীনভাবে চলে। ফলে কষ্ট সে নিজে কামাই করে নেয়।
তার মানে, যা কল্যাণকর তাই ইসলাম আর যা অকল্যাণকর তা অনইসলামী। হিসাবটা কিন্তু খুব সোজা।
এ সময়ের কোন কোন তরুণের লেখা আপনাকে বেশি টানে?
এ তালিকা অনেক বিশাল। সত্যি অনেকের লেখাই ভালো লাগে। আমারও ইচ্ছে করে তাদের নাম বলি। কিন্তু কলিকে স্বাভাবিকভাবে ফুটতে না দিয়ে টেনে ফুটাতে গেলে ফুলটাই ছিঁড়ে যাবে। তখন মানুষ না পাবে কলি, না পাবে ফুল। ফুলকে স্বাভাবিকভাবে ফুটতে দিন। দেখুন, কে কতক্ষণ দম রাখতে পারে। আপনি যার নাম বললেন, তিনি বিদেশ পাড়ি জমালেন টাকার ধান্ধায়। টাকার পিছনে ছুটতে গিয়ে সাহিত্য দপ করে নিভে গেল। তাই বলি, ওয়েট এন্ড সি। নাম অনেক, নিজে জাজ করুন আপনি ভালো লেখেন কিনা। মনে রাখবেন, কারো সার্টিফিকেটে নজরুল, রবীন্দ্র হওয়া যায় না।
সাহিত্য-সংস্কৃতি বিকাশে সংগঠনের প্রয়োজনীয়তা ও ভূমিকা সম্পর্কে যদি কিছু বলতেন?
সাহিত্য সংস্কৃতি নিজে বিকশিত হয় না, বিকশিত করতে হয়। সাহিত্যচর্চা হতো আগে রাজ দরবারে। মগ্ন বিভোর হয়ে সাহিত্য করতো সাহিত্যিক আর তার বিকাশের ভার পড়তো রাজ দরবারের। এটাই সাহিত্য বিকাশের চিরাচরিত নিয়ম। এখন রাজা নেই কিন্তু লিডারশিপ তো আছে। তারা এটা দেখবে। সংগঠন আছে, তারা এটা দেখবে।
এটা শুধু প্রচলিত নিয়ম নয়। এটা রাসূলেরও সুন্নাহ। আবু বকর, ওমর, আলী (রা.) এর মত সাহাবীদের দর্শক সারিতে বসিয়ে হাসসান বিন সাবিত (রা.) কে নবী মিম্বরে বসান নাই? বসিয়েছেন। কিন্তু নায়েবে নবীর পদ দখলের জন্য কবিদের নামিয়ে দেয়া হয়েছে মিম্বর থেকে। এটা সুন্নতের খেলাফ।
অতএব, যারা ইসলাম প্রতিষ্ঠার আন্দোলন করবেন, আন্দোলনকে বেগবান করার জন্য কবিদের এগিয়ে দেয়া তাদের দায়িত্ব। কবিরা আযান দেয়ার কাজটি করবেন, আজান শুনে মুসল্লি আসলে ইমামতি করবেন ইমামরা। আমাদের মসজিদ আছে, ইমাম আছে, মুয়াজ্জিন নাই। ফলে আজানও হয় না, জামাতও হয় না।
রাসূল (সা.) এর তো সভাকবি ছিলো। কবিদের নানাভাবে পৃষ্ঠপোষকতা করেছেন তিনি। বাংলাদেশের ইসলামী ধারার সাহিত্য-সাংস্কৃতিক সংগঠন ও সংগঠকদের এ ব্যাপারে কোন ধরনের পদক্ষেপ থাকা উচিত বলে আপনি মনে করেন?
এ ব্যাপারে গভীরভাবে সূরা আশ শোয়ারা স্টাডি করা দরকার সবার। চল্লিশদিন নবীর সংসারে আগুন জ্বলার পর যে কবি হাসসানের ভুল শোধরানোর জন্য মহান আল্লাহকে আয়াত নাজিল করতে হয়েছিল, সেই কবির শাস্তি না হয়ে কেন তাকে শায়েরুন্নবী করা হলো বিবেচনা করা উচিত। মৃত্যুদণ্ড প্রাপ্ত কবি রাসূলের সামনে কবিতা পেশ করে কি করে মৃত্যুদণ্ড মওকুফ করিয়েছিলেন সে হাদীস নিশ্চয়ই আমাদের নেতৃবৃন্দের জানা আছে। জিহাদে না গিয়েও কবিরা গণীমতের ভাগ পেতেন এসব তো কোন অলীক হাদীস নয়।
কবিরা যদি কোন উপত্যকায় গিয়ে বসে থাকে তবে তাদের বিচ্ছিন্নতার দায় কে নেবে? নেয়ার জন্য কবিকে এগিয়ে আসতে হবে, হাদীস এটাই বলে, কবিরা যাওয়ার পর তিনি গণীমতের মাল তাকে দিয়েছেন। অভিমান করে বসে থাকলে আপনিই ঠকবেন, জগতের কিছু হবে না। দূরত্ব কমান। ইসলামের রশি যেন সবাইকে এক করে দেয়।
আমরা একটা বিষয় দীর্ঘদিন ধরে লক্ষ্য করছি, ইসলামী ধারার সাহিত্য- সংস্কৃতি সংগঠনগুলো তাদের গুণীজনদেরকে বেঁচে থাকতে মূল্যায়ন করে না। মৃত্যুর পরে স্মারক প্রকাশ, মরণোত্তর পদকসহ আর কত কিছুর ব্যবস্থা করে। এ বিষয়ে আপনি কিছু বলবেন কী?
মরা ঘোড়াকে যতই ঘাস দেন সে কিন্তু আর জেহাদে যেতে পারবে না। পারলে জীবিতদের খোরাকীর ব্যবস্থা করেন, সে প্রয়োজনে আপনার জন্য প্রাণও দিতে পারবে। মনে হয়, এরচে বেশী বলার দরকার নেই।
আপনার সমবয়সী ভিন্ন চিন্তার অনেক লেখক তো বেশ মূল্যায়িত হয়েছেন। জাতীয় পুরস্কারও পেয়েছেন। সেক্ষেত্রে বলতে গেলে আপনিতো কিছুই পাননি। এ ব্যাপারে কিছু বলবেন কি?
আমি কেন পাবো? জাতীয় পুরস্কার যারা দেন তাদের জন্য আমি কি করেছি? পুরস্কারের জন্য লেখি না। স্বপ্নের জন্য লিখি। জাতির জন্য লিখি। উম্মাহর জন্য লিখি। আল্লাহ কাকে কি দেয়া দরকার ভালোই বুঝেন।
কে বলে আমি কিছু পাইনি? আল্লাহ জানেন, হজ্জে যাওয়ার টাকা আমাকে দেননি। সৌদি বাদশার আমন্ত্রণে তিনি কি আমাকে হজ্জে নিয়ে যাননি? আমাকে কি এই তেষট্টিটা বছর সম্মানের সাথে থাকা খাওয়ার ব্যবস্থা করেননি? তিনি যখন যা দেবেন হাত পেতে নেবো। আল্লাহই কবিদের কষ্ট দূর করার জন্য যথেষ্ট।
মনে রাখবেন, কবিরা হাত পাতে না। শাহনামার মূল্য দিতে না পারলে লিখতে বলেন কেন? সেই তো ফেরদৌসী তার শ্রমের মূল্য পায়, তবে মরার পরে। দয়া করে কবির জন্য কিছু না করুন, প্রতারণা করে হত্যা করবেন না।
সাংস্কৃতিক আগ্রাসন প্রতিকার ও প্রতিরোধের বিষয়টা আপনি কিভাবে দেখছেন?
আমার দেখার কিছুই নাই। এটা দেড় হাজার বছর আগে নবীজি (সা.) যে সুন্নত রেখে গেছেন সেভাবেই আছে, সেভাবেই থাকবে। রাসূলের সুন্নাহর মধ্যে মতভেদ থাকলে আপনার যেটা পছন্দ সেটা নিতে পারেন। আপনার জবাবদিহী আপনি করবেন। তবে মনে রাখবেন, ব্যাখ্যা গভীর প্রজ্ঞার সাথে করবেন। রাসূল তলোয়ার দিয়ে যুদ্ধ করেছেন তাই তলোয়ার দিয়ে যুদ্ধ করা সুন্নত এই ব্যাখ্যা দিয়ে মুসলমানদের হত্যা করার চেষ্টা করা কতটা যৌক্তিক সেটাও বিবেচনায় রাখতে হবে। যে পদ্ধতিতে মোকাবেলা করার সিদ্ধান্ত হয় সেটাই সঠিক। ঐক্যবদ্ধ সিদ্ধান্তের বিপক্ষে যায় ফেতনাবাজরা।
দেশ ও জাতি গঠনে একজন লেখকের ভূমিকা কতটুকু?
যতটুকু জাতি প্রয়োজন মনে করে। জাতি চাইলে কবিদেরকে মসজিদ থেকে বেরও করে দিতে পারে আবার চাইলে শুরিখানা থেকে ধরে এনে অজু করিয়ে মসজিদেও ঢুকিয়ে দিতে পারে। কবিরা পাওয়ার এক্সারসাইজ করে না, যারা করে তাদের চাহিদার ওপর জগত চলে।
বাংলাদেশে একটা শাশ্বত সাংস্কৃতিক বিপ্লবের জন্যে কি কি প্রয়োজন?
সাংস্কৃতিক কর্মীদের দ্বীনী এলেম ও বিভাগীয় দক্ষতা। কঠোর সিদ্ধান্ত। সুষম পরিকল্পনা। প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ। পৃষ্ঠপোষকতা। আল্লাহর সাহায্য প্রার্থনা।
বর্তমান আমাদের দেশে সাহিত্য আন্দোলনের ক্ষেত্রে দুটি ধারা প্রবাহিত- ডান এবং বাম। ডান ধারার লেখকপৃষ্ঠপোষকতার অনিশ্চয়তার মধ্যে থাকেন। ফলে তাদের কেউ কেউ ক্রমশই বাম দিকে ঝুঁকে পড়ছেন। এ ক্ষেত্রে আপনার বক্তব্য কী?
কথাটা যে কি পরিমাণ খাঁটি তা আর বলার অপেক্ষা রাখে না। আমি বহু দেখেছি। কিন্তু তার ভাগ্যে ঈমান না থাকলে আপনি কি করবেন? কেন, আল্লাহ কি মরে গেছেন? নাউজুবিল্লাহ। রাজ্জাক কি কোন ব্যক্তি, দল, না আল্লাহ? আগে ঈমান ঠিক করেন, তারপর আল্লাহর কাছে চান। তিনি অভাবমুক্ত।
আপনার জীবনের সার্থকতা কী?
আল্লাহই ভালো জানেন। তিনি যদি আমাকে মাফ করে দেন সেটাই হবে আমার জীবনের সার্থকতা। আপনাদের কাছে এই দোয়ার আবদার ও আকুতিটুকু থাকবে আমার।
নবীনদের জন্য আপনার কোন পারমর্শ বা উপদেশ আছে?
দেখুন, যেদিন থেকে দুনিয়া সৃষ্টি হয়েছে সেদিন থেকেই মানুষের মাঝে অভাববোধ তৈরী হয়েছে। সমস্যা সৃষ্টি হয়েছে এবং কেয়ামত পর্যন্ত তা থাকবে। অভাববোধ ও সমস্যা হচ্ছে মানুষের চালিকাশক্তি। অভাব ও সমস্যা আছে বলেই তা উত্তরণের চেষ্টা আছে, কাজের স্পৃহা আছে, উদ্যম আছে, সাহস আছে। আর এসব আছে বলেই সভ্যতা এগিয়ে চলেছে। ফলে কখনো নিরাশ হতে নেই, হতোদ্যম হতে নেই।
মনে রাখতে হবে, নষ্টামীর মোহ সাময়িক, কিন্তু সুন্দরের আকাক্সক্ষা চিরন্তন। মানব সভ্যতা টিকে থাকবে সুন্দরের এক সুতীব্র আকাক্সক্ষা নিয়েই।
আপনাকে অসংখ্য ধন্যবাদ জানাচ্ছি। আমাদেরকে আপনার মূল্যবান সময় দেবার জন্য।
আপনাদেরকেও ধন্যবাদ। দেশবাসীকে আমার সালাম ও শুভেচ্ছা।