২২ জানুয়ারি, ২০২৫ ১৪:৫৮ পি এম
সুন্দর এই পৃথিবী মহান আল্লাহর অপার করুনা। এ পৃথিবীতে রয়েছে নানা রঙ, অপূর্ব রূপ। উঁচু-নীচু পর্বত, দিগন্ত বিস্তৃত সবুজ মাঠ। নদীর কুল কুল রব। সবুজের ছায়াঘেরা বিস্তীর্ণ বনভূমি। বর্ষার রিমঝিম বৃষ্টি, নদীর স্রোতধারা আর সাগরের ঢেউ। এসবের উপরে পৃথিবীকে আরো বর্ণিল রূপে উপস্থাপন করে এ পৃথিবীর বুকে বিচরণশীল নানা প্রজাতির পশু-পাখি। কার না ভালো লাগে পাখিদের কলরব? রংবেরঙ্গের পশু ও সরীশৃপ জাতীয় প্রাণী আমাদের এই ধরাকে করেছে আরো আনন্দময়, মনোমুগ্ধকর, চিত্তাকর্ষক। কিন্তু দূঃখের সাথে বলতে হয় কতিপয় মানুষ নামের অমানুষ পশুপাখিদের সাথে নির্মম আচরণ ও অবাধে প্রাণীবধের মাধ্যমে প্রকৃতির এই রূপরহস্যকে বাধাগ্রস্থ করে তুলছে।
মনে রাখতে হবে, সৃষ্টির সেরা জীব মানুষের শারীরিক সমৃদ্ধিতে প্রোটিনের চাহিদা মেটানো ও মনোরঞ্জন ও চিত্তবিনোদনের জন্য সর্ব্বপরি এ পৃথিবীর ভারসাম্য রক্ষায় এবং টেকসই উন্নয়নে মহান রব সৃষ্টি করেছেন নানাবিধ পশু, পাখি, কীটপতঙ্গ ও সরীসৃপ জাতীয় প্রাণী এবং এদের বসবাসের ব্যবস্থা করেছেন পৃথিবীর জলে স্থলে ও অন্তরিক্ষে।রাতের অন্ধকারে আরামের ঘুম বিসর্জন দিয়ে কুকুর পাহারা দেয় মনিবের বাসগৃহ, রক্ষা করে অসাধু লোকের কুকর্ম থেকে।শিকারি কুকুর এনে দেয় উপাদেয় খাদ্য, গোয়েন্দা কুকুর সাহায্য করে অপরাধী শনাক্ত করতে।উট-ঘোড়া-হাতি দুর্গম মরু-পাহাড়ি পথে বাহন হিসেবে উপকার করে।কৃষিকাজে অবদান রাখে গরু ও মহিষ।বিড়াল বন্ধ করে ইঁদুরের উপদ্রব।এভাবে অসংখ্য পশুপাখি আমাদের যাপিত জীবনে জড়িয়ে আছে আত্মার আত্মীয়ের মতো।এসকল প্রাণী যদি বিপন্ন হয় তাহলে পৃথিবীর সৌন্দর্যই শুধু বিনষ্ট হবে না বরং আশরাফুল মাখলুকাত হিসেবে সৃষ্টি মানুষের অস্তিত্ব হুমকির মুখে পড়বে।পরিসংখ্যান বলছে-ওয়ার্ল্ড ওয়াইল্ডলাইফ ফান্ড এক প্রতিবেদনে জানায়, ১৯৭০ সাল থেকে বিশ্বে এ পর্যন্ত বন্যপ্রাণীর সংখ্যা কমেছে দুই-তৃতীয়াংশ। এভাবে বাংলাদেশের ভূখন্ড থেকে হারিয়ে গেছে ৩১ প্রজাতির প্রাণী।এছাড়াও বাংলাদেশের অন্তত ২১৯ প্রজাতির বন্যপ্রাণী বিপণ্ন।এই তালিকার মধ্যে আছে-উভচর সরীসৃপ, পাখি, স্তন্যপায়ী প্রাণী।
এসব তথ্য ও পরিসংখ্যানে অধুনিক প্রানীবিজ্ঞানীদের টনক নড়েছে। তাই তো প্রাণীদের জীবন রক্ষা ও তাদের কল্যাণে নানা পরিকল্পনা গ্রহন করছে। এরই ফলশ্রুতিতে বিশ্বব্যাপী প্রতি বছর ৪ অক্টোবর পালিত হয়ে আসছে ‘বিশ্ব প্রাণী দিবস’। এই দিবসের মূল লক্ষ্য হলো-পৃথিবীর প্রতিটি প্রান্তে প্রাণীদের কল্যাণের মাধ্যমে তাদের অবস্থার উন্নতি করা। অথচ আজ থেকে ১৪০০ বছর আগেই ইসলাম এর গুরুত্ব অনুধাবন করে কার্যকরি পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য বিশ্ববাসীকে সজাগ করেছেন। আসুন, জেনে নেই ইসলাম এ ব্যাপারে কী ভুমিকা নিয়েছে।
পবিত্র কুরআনে বর্ণিত হয়েছে, ‘পৃথিবীতে বিচরণশীল যত প্রাণী আছে, আর যত পাখি দুই ডানা মেলে উড়ে বেড়ায়, তারা সবাই তোমাদের মতো স্বতন্ত্র জাতি।’(সুরা আনআম, আয়াত: ৩৮) পবিত্র কুরআনের ২০০টি আয়াতে প্রাণী সম্পর্কে বর্ণনা করা হয়েছে এবং ৩৫টি প্রাণীর নাম কুরআনে উল্লেখ আছে। পবিত্র কুরআনে আল্লাহ তায়ালা ৫টি প্রাণীর নামে সূরার নামকরণ করেছন।যেমন:সুরা বাকারা(গাভি), সুরা নাহল (মৌমাছি), সুরা নামল (পিপীলিকা), সুরা আনকাবুত(মাকড়সা), সুরা ফিল (হাতি) ইত্যাদি। আবার ‘আনআম’ পশুসম্পদ(উট, গরু, বকরি প্রভৃতি গবাদিপশু)নামে আল্লাহ তায়ালা স্বতন্ত্র একটি সূরাই নাজিল করেছেন। মানবজাতির জন্য হেদায়াতের দিশারি পবিত্র কুরআনে এমন নামকরণ থেকেও প্রাণীর প্রতি ইসলামের দৃষ্টিভঙ্গি অনুমিত হয়। এ সব কিছুই পশু-পাখির প্রতি ভালোবাসার নিদর্শন।
আমরা জানি বিশাল এই সৃষ্টি জগতে মানুষকে আখ্যায়িত করা হয়েছে-আশরাফুল মাখলুকাত তথা সৃষ্টির সেরা জীব। সৃষ্টিজগতের সব কিছুই মানুষের সেবায় নিয়জিত। তাই মানুষ হিসেবে আমাদের রয়েছে কিছু দায়-দায়িত্ব।
হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সা.)বলেছেন, ‘পৃথিবীতে যারা আছে তাদের প্রতি তোমরা দয়া করো, তাহলে যিনি আসমানে আছেন তিনিও তোমাদের প্রতি দয়া করবেন।’ (আবু দাউদ, হাদিস ন. ৪৯৪১)
পৃথিবীতে জানা-অজানা নানা ধরনের জীব-জন্তু রয়েছে। এসবের প্রতি মায়া-মমতা পোষণ করতে হবে। আবু হুরায়রা (রা.)-এর সূত্রে এক হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, রাসূলুল্লাহ (সা.) বলেন, ‘যে দয়া করে না, সে দয়া পায় না।’(সহিহ মসুলিম, হাদিস ন. ২৩১৮।
আরেক হাদিসে ইরশাদ হয়েছে, আবু হুরায়রা (রা.) বর্ণনা করেন, এক যৌনকর্মী প্রচণ্ড গরমে হেঁটে যাচ্ছিল। পথে একটি কুকুরকে দেখতে পেল, পিপাসায় কাতর হয়ে কূপের কাছে চক্কর দিচ্ছে। পিপাসায় তার জিহ্বা বের হয়ে গেছে। তখন সে তার চামড়ার মোজা দিয়ে কূপ থেকে কুকুরের জন্য পানি তুলে আনল এবং কুকুরকে পান করালো। ফলে আল্লাহ তায়ালা তাকে মাফ করে দিলেন। (সহিহ মুসলিম, হাদিস ন. ৫৬৬৫।)
অবৈধ যৌনকর্ম নিকৃষ্টতম পাপ। কিন্তু একটি অসহায় প্রাণীর প্রতি সে দয়াপ্রবণ হয়েছে, তাই আল্লাহ তায়ালা তার ওপর দয়াপরবশ হয়ে ক্ষমা করে দিয়েছেন, ভেবে দেখেছেন কি?
আবদুল্লাহ (রা.) বর্ণনা করেন, এক স্ত্রীলোককে একটি বিড়ালের কারণে আজাব দেওয়া হয়। কারণ সে বিড়ালটিকে বেঁধে রাখতো। নিজেও পানাহার করাতো না। আবার ছেড়েও দিতো না, যাতে সে জমিনের পোঁকা-মাকড় খেতে পারে। অবশেষে বিড়ালটি মারা গেল।(সহিহ মুসলিম, হাদিস ন. ৫৬৫৭)
কী অবাক কথা! একজন অসতী নারী জীবের সেবা করে জান্নাত পেলো, আর একজন সতী নারী জীবে কষ্ট দিয়ে শাস্তিযোগ্য হলো।
পশুপাখির অধিকার রক্ষায় ইসলামের অবদান অনস্বীকার্য। যেমন হাদিসে এসেছে:
কাতাদা (রা.) বর্ণনা করেন, রাসূলুল্লাহ (সা.) মাটির গর্তে পেশাব করতে নিষেধ করেছেন। (আবু দাউদ, হাদিস ন. ২৯) কারণ, গর্তে বিভিন্ন প্রজাতির পোঁকা-মাকড় বসবাস করে। পেশাব করলে তাদের বসতস্থান নষ্ট হবে, কষ্ট হবে। তাই রাসূলুল্লাহ (সা.) গর্তে পেশাব করতে নিষেধ করেছেন। ইসলামের নবি মুহাম্মাদ (সা.) কোনো প্রাণীকে অযথা কষ্ট দিতে কঠোর ভাবে নিষেধ করেছেন। উল্লেখ্য রাসূলুল্লাহ (সা.)-এর কাছে অনেক সময় সদকার উট আসতো। এগুলোকে চিহ্নিত করার জন্য লোকেরা লোহা গরম করে প্রাণীর মুখে দাগ লাগাতো। এতে পশুগুলোর কষ্ট হতো। তাই রাসূলুল্লাহ (সা.) ঘোষনা দিলেন, তোমরা গাধা কিংবা উটের মুখে দাগ লাগিও না। যদি লাগাতেই হয়, তবে নিতম্বের ওপর দাগ লাগাও।(সহিহ মুসলিম, হাদিস ন. ৫৩৭০)
একদা রাসুল (সা.) একটি গাধার পাশ বেয়ে পার হলেন। গাধাটির মুখে দাগার দাগ দেখে তিনি বললেন, ‘‘আল্লাহ তাকে অভিশাপ করুন, যে একে দেগেছে।” (মুসলিম, মাকতাবাতুশ শামেলা হাদিস ন.২১১৬) উক্ত হাদিসটি পশুর ওপর দরদের প্রমাণ বহন করে।
একদিনের ঘটনা। রাসুলুল্লাহ (সা.) এক আনসারী সাহাবীর খেজুর বাগানে প্রবেশ করলে হঠাৎ একটি উট দৃষ্টিগোচর হলো। উটটি নবী (সা.)-কে দেখে কাঁদতে লাগল। নবীজি (সা.) অনেক ব্যথিত হলেন। উটটির কাছে গিয়ে তার মাথায় হাত বুলিয়ে আদর করলেন। এতে উটটির কান্না বন্ধ হয়ে গেল। তিনি জিজ্ঞেস করলেন, এ উটের মালিক কে? এক আনসারী যুবক এসে বলল, হে আল্লাহর রাসুল! আমি। নবীজি (সা.) বললেন, ‘আল্লাহ যে তোমাকে এই নিরীহ প্রাণীটির মালিক বানালেন, এর ব্যাপারে তুমি কি আল্লাহকে ভয় কর না? উটটি আমার কাছে অভিযোগ করেছে, তুমি একে ক্ষুধার্ত রাখ এবং কষ্ট দাও!’ (আবু দাউদ, হাদিস ন. ২৫৪৯)
ইসলামের প্রবর্তক মুহাম্মাদ (সা.) যেমনিভাবে মানুষের অধিকার দিয়েছেন, মানুষের দুঃখ দূর করার জন্য যেমন পদক্ষেপ নিতেন, তেমনি তিনি জীবজন্তু পশুপাখির অধিকার রক্ষায় পদক্ষেপ নিয়েছেন। কেননা তিনি ছিলেন জগৎবাসীর জন্য রহমত স্বরূপ। আল্লাহ তায়ালা কুরআনে বলছেন: “আমি তো তোমাকে সৃষ্টিকুলের জন্য শুধু রহমতরূপেই প্রেরণ করেছি।” (সুরা আম্বিয়া, আয়াত ১০৭) প্রাণীদের অধিকার রক্ষার ব্যাপারে মহানবি সর্বোচ্চ সতর্কতা অবলম্বন করে বলেন, নিশ্চয় আল্লাহ তায়ালা কোমল হৃদয়বান, তিনি কোমলতা পছন্দ করেন, তিনি এতে আনন্দিত হন এবং সাহায্য করেন, যা কঠোরতার সময় করেন না। যখন তোমরা এসব বাকশক্তিহীন সওয়ারীর ওপর আরোহণ কর, তখন তাকে সাধারণ মঞ্জিলে নামাও (অর্থাৎ স্বাভাবিক দূরত্বের অধিক চালিয়ে অধিক কষ্ট দিও না)। যেখানে বিশ্রাম করবে, সেখানকার জায়গা যদি অনুর্বর হয় এবং ঘাস না থাকে তবে শিগগিরই সেখান থেকে তাকে বাহির করে নিয়ে যাও নতুবা তার হাড় শুকিয়ে যাবে। (অর্থাৎ ঘাসপাতাহীন জায়গায় বিলম্ব করলে উহারা না খেয়ে শুকিয়ে যাবে। ফলে হাঁটতে পারবে না।) আর তোমাদের জন্য রাতে ভ্রমণ করাই উচিত। কারণ রাতে যেই পরিমাণ পথ অতিক্রম করা যায় দিনে তা হয় না। রাতে যদি কোনো স্থানে অবস্থান কর, তবে পথে অবস্থান করো না। কেননা সেখানে জীবজন্তু চলাফেরা করে এবং সাপ বাস করে।(মুয়াত্তা ইমাম মালিক, হাদিস ন. ১৭৬৭)
মনে রাখতে হবে যে, প্রাণীদের অযথা কষ্ট দেওয়া পাপ। মানুষের খাদ্য চাহিদা মেটাবার জন্য আল্লাহ তায়ালা কোনো কোনো পশুপাখিকে তাদের জন্য হালাল করেছেন এবং খাদ্য প্রস্তুত প্রক্রিয়াটাও অনেকটা সহনীয় পর্যায়ে সম্পাদনের পন্থা বাতিয়ে দিয়েছেন। আর তা হলো: ধারালো ছুরি দিয়ে দ্রুত যবেহ করা। এই হালাল পশু যবাই করার সময়ও ইসলাম আমাদেরকে যবাই করার সময় পশুর প্রতি দয়া ও অনুগ্রহ প্রদর্শন করতে বলেছে।
রাসুলুল্লাহ(সা.)বলেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক বিষয়ে তোমাদের ওপর ‘ইহসান’অত্যাবশ্যক করেছেন। অতএব তোমরা যখন (নিজেদের নিরাপত্তা ও আত্মরক্ষায় ক্ষতিকর প্রাণীকে) তাদেরকে হত্যা করতে বাধ্য হবে, তখন দয়ার্দ্রতার সঙ্গে হত্যা করবে; আর যখন (অতীব প্রয়োজনে, খাদ্য গ্রহণের তাগিদে, মাংস সংগ্রহের জন্য তাদেরকে) জবাই করবে তখন দয়ার সঙ্গে জবাই করবে। তোমাদের সবাই যেন ছুরি ধারালো করে নেয় এবং তার জবাইকৃত জন্তুকে কষ্টে না ফেলে।’(সহীহ মুসলিম, হাদিস ন. ১৯৫৫)
এই দয়া প্রদর্শন করতে গিয়েই বধ্য পশুর সম্মুখেই ছুরি শান দেওয়া উচিত নয় (মকরূহ)। যেহেতু রাসূল (সা.) ছুরি শান দিতে এবং তা পশু থেকে গোপন করতে আদেশ করেছেন এবং বলেছেন, ‘‘যখন তোমাদের কেউ যবেহ করবে, তখন সে যেন তাড়াতাড়ি করে।” (মুসনাদ আহমাদ ২/১০৮; মাকতাবাতুশ-শামেলা, হাদিস ন. ৩১৭২, সহীহ তারগীব ১/৫২৯) এমন কি এক পশুর সামনে অন্য পশুকে যবেহ করাও নিষেধ।
ফিকাহবিদগন বলেন, জবাই করার জন্য পশুদের টেনেহেঁচড়ে নিয়ে যাওয়া যাবে না। পরিপূর্ণ নিস্তেজ হওয়ার আগে ছুরিকাঘাত কিংবা চামড়া সরানো যাবে না। এসব কাজ মাকরুহে তাহরিমি।
পিঁপড়া দংশন না করলে তাদের মেরে ফেলা মাকরুহ। আর এদের পানিতে নিক্ষেপ করা সর্বাবস্থায় নিষিদ্ধ। বিচ্ছুকেও আগুনে পুড়ে ফেলা মাকরুহ।’ (ফতোয়ায়ে বাজ্জাজিয়া, ৬/৩৭০)
জীবিত থাকা অবস্থায় পশু-পাখির কোনো অঙ্গ কাটা যাবে না। নবী করিম (সা.) বলেছেন, ‘জীবিত অবস্থায় যে প্রাণীর কোনো অংশ কাটা হয়, সেটা মৃত তথা হারাম হয়ে যাবে।’ (তিরমিজি, হাদিস ন. ১৪৮০)
পশু-পাখির চেহারায় প্রহার করা, অঙ্কিত করা ও চিহ্ন ব্যবহার করে চেহারা বিকৃত করা ইসলামে নিষিদ্ধ। জাবের (রা.) থেকে বর্ণিত, ‘রাসুল (সা.) চেহারায় প্রহার ও অঙ্কন করতে নিষেধ করেছেন।’ (মুসলিম, হাদিস ন. ২১১৬)
খামাখা কোনো পশু-পক্ষীকে কষ্ট দেওয়া, কোনো পশুকে তার সাধ্যাতিরিক্ত বোঝা বহনে বাধ্য করা ও মারধর করা বৈধ নয়। কোনো পশু-পক্ষী কিছু অনিষ্ট করে ফেললে, গরু-মহিষ গাড়ি বা হাল টানতে অক্ষম হয়ে পড়লে তাদেরকে অতিরিক্ত প্রহার করাও জায়েজ নয়। পশু-পাখির সঙ্গে যথাসম্ভব দয়াশীল আচরণ করতে হবে। এদের সঙ্গে যথেচ্ছা ব্যবহার করা যাবে না। পশু-পাখির অঙ্গহানি করা নিষিদ্ধ। একবার ইবনে ওমর (রা.) কিছু কুরাইশ যুবকের নিকট দিয়ে যাচ্ছিলেন। তারা একটি পাখি বেঁধে সেটির দিকে তীর নিক্ষেপ করছিল। আর প্রত্যেকটি নিশানা ব্যর্থ হওয়ার কারণে তারা পাখির মালিকের জন্য একটি করে তীর নির্ধারণ করছিল। তারপর তারা ইবনে ওমর (রা.)-কে দেখে আলাদা হয়ে গেল। ইবনে ওমর (রা.) বললেন, কে এ কাজ করল? যে ব্যক্তি এরূপ করেছে তার প্রতি আল্লাহর লানত। যে কোনো জীবজন্তুকে লক্ষ্যস্থল বানায় রাসুলুল্লাহ (সা.) তাকে লানত করেছেন। (মুসলিম, হাদিস ন. ১৯৫৮)
কোনো প্রাণীকে অযথা কষ্ট দিলে অবশ্যই এর শাস্তি ভোগ করতে হবে। রাসুল (সা.) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি কোনো চড়ুইকে অযথা হত্যা করল, তা কিয়ামতের দিন আল্লাহ তায়ালার নিকট উঁচু স্বরে ফরিয়াদ করে বলবে, ইয়া আল্লাহ!অমুক ব্যক্তি আমাকে অযথা হত্যা করেছিল, সে কোনো লাভের জন্য আমাকে হত্যা করেনি।’(নাসায়ি, হাদিস ন. ৪৪৪৬)।
জীবে-দয়া প্রদর্শন করতে আদিষ্ট হয়েছে প্রত্যেক মুসলিম। সুতরাং পশু-পক্ষীর প্রতি কি ধরনের আচরণ করতে নির্দেশ দেয় ইসলাম তা আমাদের জানা প্রয়োজন।
সৌন্দর্যের জন্য কোনো পাখিকে পিঞ্জারায় বা মাছকে পানির হাউয বা কাঁচের পাত্রে আবদ্ধ করতে পারেন। তবে শর্ত হল, যেন তার প্রতি কোনো প্রকার অত্যাচার না করা হয়; যথাসময়ে পানাহার করতে দেওয়া হয় এবং তার প্রতি দয়া ও স্নেহ প্রদর্শন করা হয়।(ফাতাওয়া উলামাইল বালাদিল হারাম ১১৯৮পৃ.)
গৃহপালিত অথবা পিঞ্জারাবদ্ধ পশু বা পক্ষী হলে তাকে নিয়মিত পানাহার করতে দিতে হবে। তা না দিলে এবং তার ফলে সে মারা গেলে গোনাহগার হতে হবে।
একদা রাসুল (সা.) একটি উটকে দেখলেন, (ক্ষুধায়) তার পিঠের সাথে পেট লেগে গেছে। তা দেখে তিনি বললেন, ‘‘তোমরা এই অবলা জন্তুদের ব্যাপারে আল্লাহকে ভয় কর। সুতরাং উত্তমভাবে তাতে সওয়ার হও এবং উত্তমভাবে তা খাও (বা তার পিঠ থেকে নেমে যাও)।”
রাসুল (সা.) একদা এক সাহাবীকে বলেন, ‘‘তুমি যদি তোমার বকরীর প্রতি দয়া প্রদর্শন কর, আল্লাহ তোমার প্রতি দয়া প্রদর্শন করবেন।” (সহীহ তারগীব, হাদিস ন. ২২৬৪)
পশু-পক্ষী কিছু অনিষ্ট করে ফেললে, গরু-মহিষ গাড়ি বা হাল টানতে অক্ষম হয়ে পড়লে তাদেরকে নিষ্ঠুরভাবে প্রহার তো দুরের কথা অকথ্য গালি এবং ইচ্ছামত অভিশাপ দিতেও রাসুল (সা.) নিষেধ করেছেন।
এক সফরে আনসারদের এক মহিলা তার সওয়ারী উষ্ট্রীকে অভিশাপ বা গালি দিলে রসূল (সা.)বলেন, ‘‘ওর পিঠে যা আছে তা নিয়ে ওকে ছেড়ে দাও, কারণ ও অভিশপ্তা।” (মুসলিম)
এক দাসী তার সওয়ারী উষ্ট্রীকে বলল, ‘ধুৎ, আল্লাহ একে অভিশাপ দাও!’ রাসুল (সা.) এ কথা শুনে বললেন, ‘অভিশপ্ত উষ্ট্রী যেন আমাদের সঙ্গে না আসে।’(মুসলিম)
উট, ঘোড়া বা গাধার পিঠে সওয়ার হয়ে কোথাও যাওয়া ছাড়া তার পিঠে খামাখা বসে থেকে কষ্ট দেওয়া যাবে না, তার পিঠে চড়ে কোনো কাজ করা যাবে না। তদনুরূপ গরু বা মহিষের কাঁধে গাড়ির জোঁয়াল রেখে কোনো কাজ করা যাবে না। যেহেতু দয়ার নবী (সা.) সওয়ারীর পিঠকে মিম্বর বানাতে নিষেধ করেছেন।(আবূ দাঊদ, বাইহাক্বী, সিলসিলাহ সহীহাহ, মাকতাবাতুশ-শামেলা, হাদিস ন. ২২)
কোনো হারাম পশু-পাখি অথবা খাওয়ার ইচ্ছা ছাড়া কোনো হালাল পশু-পাখি খামাখা হত্যা করবেন না। পাখির ছানা ধরে বাচ্চাদেরকে খেলতে দেবেন না।
রাসুল (সা.) বলেন, ‘‘আল্লাহর নিকট সব চাইতে বড় পাপিষ্ঠ সেই ব্যক্তি, যে কোনো মহিলাকে বিবাহ করে, অতঃপর তার নিকট থেকে মজা লুটে নিয়ে তাকে তালাক দেয় এবং তার মোহরও আত্মসাৎ করে। (দ্বিতীয় হল) সেই ব্যক্তি, যে কোনো লোককে মজুর খাটায়, অতঃপর তার মজুরী আত্মসাৎ করে এবং (তৃতীয় হল) সেই ব্যক্তি, যে খামাখা পশু হত্যা করে।” (হাকেম, বাইহাকী, সহীহুল জামে, হাদিস ন. ১৫৬৭)
আব্দুল্লাহ বিন মাসঊদ (রাঃ) বলেন, একদা আমরা আল্লাহর রসূল (সা.) এর সাথে এক সফরে ছিলাম। তিনি নিজ প্রয়োজনে (সরে) গেলে আমরা ‘হুম্মারাহ’(নামক লাল রঙের চড়ুই জাতীয় একটি) পাখি দেখলাম। তার সাথে ছিল তার দুটি ছানা। আমরা সেই ছানা দুটিকে নিয়ে গেলাম। পাখিটি আমাদের মাথার উপরে ঘুরে-ফিরে উড়তে লাগল। ইতোমধ্যে নবী (সা.) এসে তা দেখে বললেন, ‘‘কে ওকে ওর ছানা নিয়ে কষ্ট দিয়েছে? ওর ছানা ওকে ফিরিয়ে দাও।” একদা তিনি দেখলেন, পিঁপড়ের গর্তসমূহকে আমরা পুড়িয়ে ফেলেছি। তিনি তা দেখে বললেন, ‘‘কে এই (পিঁপড়েগুলি)কে পুড়িয়ে ফেলেছে?’’ আমরা বললাম, ‘আমরাই।’ তিনি বললেন, আগুনের মালিক (আল্লাহ) ছাড়া আগুন দ্বারা শাস্তি দেওয়া আর অন্য কারো জন্য সঙ্গত নয়।” (আবূ দাঊদ, হাকেম, সিলসিলাহ সহীহাহ মাকতাবাতুশ শামেলা, হাদিস ন. ২৫)
তাই আসুন, আমরা সব ধরনের প্রাণীর প্রতি সদয় ও স্নেহশীল হই। তাদের জন্য ভালোবাসা ও মমতা লালন করি এবং প্রকৃতির সৌন্দর্য রক্ষায় মনোযোগী হই।