৫ সেপ্টেম্বর, ২০২৪ ১০:৫৫ এএম
জাতীয় সংগীত প্রতিটি দেশের জাতীয় পরিচয় ও ঐতিহ্যের প্রতীক। এটি দেশের ইতিহাস, সংস্কৃতি, এবং মূল্যবোধকেও তুলে ধরে বিশ্বের সামনে। তবে বিভিন্ন সময়ে রাজনৈতিক, সামাজিক, এবং সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে বিভিন্ন দেশ তাদের জাতীয় সংগীতে পরিবর্তন এনেছে। এমন পরিবর্তনগুলো সাধারণত জাতীয় উন্নতি, লিঙ্গ সমতা, বা নতুন রাজনৈতিক বাস্তবতার প্রতিফলন ঘটানোর জন্যই করা হয়। বিশ্বের যেসব দেশ তাদের জাতীয় সংগীতে পরিবর্তন এনেছে এবং এর পেছনের কারণগুলো তুলে ধরছি কালচারাল টাইমসের এই আয়োজনে-
অস্ট্রেলিয়া: অস্ট্রেলিয়ার জাতীয় সংগীতে সাম্প্রতিককালে একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন এসেছে। ২০২১ সালের ১ জানুয়ারি থেকে অস্ট্রেলিয়ায় জাতীয় সংগীতের ‘ইয়াং অ্যান্ড ফ্রি’ শব্দগুচ্ছটি পরিবর্তন করা হয়। প্রধানমন্ত্রী স্কট মরিসন ঘোষণা দেন, আদিবাসীদের সুদীর্ঘ ইতিহাস ও ঐতিহ্যকে সম্মান জানাতে এই পরিবর্তন আনা হয়েছে। নতুন জাতীয় সংগীতটি দেশের বহুজাতিক এবং আদিবাসী সংস্কৃতির সঙ্গে সামঞ্জস্যপূর্ণ করার চেষ্টা করে।
জার্মানি: জার্মানিতে লিঙ্গ সমতা নিয়ে আলোচনা দীর্ঘদিন ধরে চলেছে, যার একটি প্রতিফলন দেখা যায় জাতীয় সংগীত পরিবর্তনের প্রস্তাবে। জার্মানির সমতা বিষয়ক কমিশনার ক্রিস্টিন রোজে-ম্যোরিং প্রস্তাব করেন যে, ‘ফাটারল্যান্ড’ (পিতৃভূমি) শব্দটি পরিবর্তন করে ‘হাইমাট’ (জন্মভূমি) শব্দটি ব্যবহার করা হোক, যাতে জাতীয় সংগীতে লিঙ্গ সমতা প্রতিফলিত হয়। যদিও এই প্রস্তাবটি বিতর্কিত ছিল এবং চ্যান্সেলর আঙ্গেলা ম্যার্কেলসহ অনেকে এর বিরোধিতা করেন, তবু এটি জার্মানির সামাজিক উন্নতির জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ পদক্ষেপ হিসেবে ধরা যায়।
অস্ট্রিয়া: অস্ট্রিয়ায় ২০১২ সালে জাতীয় সংগীতে লিঙ্গ সমতা আনতে একটি গুরুত্বপূর্ণ পরিবর্তন আনা হয়। ‘ছেলেরা’র জায়গায় ‘মেয়েরা এবং ছেলেরা’ শব্দটি সংযোজন করা হয়। এটি দেশের ঐতিহ্যগত চিন্তাধারার পরিবর্তন এবং নারী ও পুরুষের সমান অধিকারের প্রতিফলন হিসেবে দেখা হয়।
কানাডা: কানাডাও লিঙ্গ নিরপেক্ষতার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে তাদের জাতীয় সংগীত পরিবর্তন করেছে। সংগীতের দ্বিতীয় লাইনে ‘তোমার সব ছেলেরা’র পরিবর্তে ‘আমরা সবাই’ শব্দগুচ্ছটি সংযোজন করা হয়। এই পরিবর্তনটি দেশটির সাম্প্রতিক লিঙ্গ সমতা প্রচেষ্টার একটি গুরুত্বপূর্ণ উদাহরণ।
নেপাল: নেপালের ইতিহাসে ২০০৮ সাল একটি গুরুত্বপূর্ণ বছর, কারণ এই বছরে দেশটি আনুষ্ঠানিকভাবে রাজতন্ত্রের অবসান ঘটায়। এর প্রেক্ষিতে, ২০০৭ সালে নেপাল তাদের জাতীয় সংগীতে পরিবর্তন আনে। পূর্বের জাতীয় সংগীতটি রাজতন্ত্রের প্রশংসায় পূর্ণ ছিল, যা নতুন গণতান্ত্রিক প্রেক্ষাপটে অপ্রাসঙ্গিক হয়ে পড়েছিল। নতুন জাতীয় সংগীতটি দেশের গণতান্ত্রিক ভাবমূর্তির প্রতীক হয়ে উঠেছে।
আফগানিস্তান: আফগানিস্তানের জাতীয় সংগীতে একাধিকবার পরিবর্তন আনা হয়েছে। তালেবান শাসনামলে দেশটিতে কোনো জাতীয় সংগীতই ছিল না। পরে ২০০২ সালে পুরনো জাতীয় সংগীত ফিরিয়ে আনা হয়, যা ১৯৭৮ সালে গৃহীত হয়েছিল। এরপর ২০০৬ সালে, তৎকালীন কারজাই সরকার জাতীয় সংগীতে পরিবর্তন এনে একটি নতুন সংগীত গ্রহণ করে, যা নতুন আফগানিস্তানের প্রতীক হিসেবে বিবেচিত হয়।
রুয়ান্ডা: রুয়ান্ডা ১৯৯৪ সালে ভয়াবহ গণহত্যার শিকার হয়। গণহত্যার পরবর্তী সময়ে দেশটির ভাবমূর্তি গড়ে তোলার প্রয়াসে ২০০১ সালে একটি নতুন জাতীয় সংগীত বেছে নেয়া হয়। এই নতুন সংগীতটি দেশের ঐতিহ্য এবং নতুন জাতীয় ঐক্যের প্রতীক হিসেবে দেখা হয়।
দক্ষিণ আফ্রিকা: দক্ষিণ আফ্রিকা ১৯৯৭ সালে তাদের জাতীয় সংগীতে একটি উল্লেখযোগ্য পরিবর্তন আনে। আগের দুটি জাতীয় সংগীতের কিছু অংশ নিয়ে একটি নতুন জাতীয় সংগীত রচনা করা হয়, যা আফ্রিকান এবং ইংরেজি ভাষায় লেখা। এই নতুন সংগীতটি বর্ণবাদ-পরবর্তী দক্ষিণ আফ্রিকার রিকনসিলিয়েটরি মনোভাবের প্রতীক।
রাশিয়া: রাশিয়ার জাতীয় সংগীতে বড় ধরনের পরিবর্তন আসে ২০০০ সালে, যখন ভ্লাদিমির পুটিন রুশ প্রেসিডেন্ট হিসেবে দায়িত্ব নেন। তিনি ১৯৯০ সালের আগে ব্যবহৃত জাতীয় সংগীত ফিরিয়ে আনেন, তবে গানের কথায় কিছুটা পরিবর্তন আনা হয়। এই পরিবর্তনটি ছিল দেশের পুরোনো ঐতিহ্যকে পুনরুজ্জীবিত করার প্রচেষ্টা।
জাতীয় সংগীতের পরিবর্তন শুধু সুর বা শব্দের পরিবর্তন নয়, এটি একটি দেশের সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের প্রতিফলন। জাতির পরিবর্তিত মূল্যবোধ এবং নতুন চ্যালেঞ্জের সঙ্গে তাল মিলিয়ে জাতীয় সংগীতের পরিবর্তন একটি প্রাকৃতিক প্রক্রিয়া।