২০ মে, ২০২৪ ১০:২১ এএম
মুহাম্মদ ইব্রাহিম বাহারী আমাদের এ সময়ে সাহিত্যাঙ্গনে অতি সুপরিচিত এক নাম। তিনি দীর্ঘদিন যাবত দেশের অনেক জাতীয় পত্রপত্রিকায় নিয়মিত লিখছেন। তিনি একজন প্রতিবাদী ছড়াকার, কবি এবং কথাসাহিত্যিক। সাহিত্যের বিভিন্ন শাখায় লিখলেও তিনি একজন শিশু সাহিত্যিক হিসেবে সমধিক পরিচিত। সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে শিশুদের জন্য এক মনোরম ছড়াগ্রন্থ “চড়ুইভাতি”। গ্রন্থটিতে রয়েছে মোট ৩৮ টি ছড়া। ছড়াগুলো নানা ছন্দে ও বর্ণে সাজানো এবং প্রতিটি ছাড়ার সঙ্গে রয়েছে নানা রঙের সাদৃশ্য ছবি। যা দেখলে শুধু শিশুরা নয় শিশুদের মা-বাবাদেরও পড়তে ইচ্ছে করবে।
কেউ কেউ বলেন, ছোটদের জন্য লেখা খুবই সহজ কিন্তু কথাটা সঠিক নয় বরং ছোটদের মনের উপযোগী ছড়া কবিতা লেখা মোটেই সহজ নয় বরং কঠিন এবং এটি এক গুরুত্বপূর্ণ কাজ অর্থাৎ গুরুত্বপূর্ণ সাহিত্যকর্ম । শিশুদের কি ভালো লাগে আর কি ভালো লাগে না তাদের মনের খবর আমরা অনেকেই জানিনা। শিশু মন যেমন সহজ সরল তেমনি বিচিত্র এবং অস্থির চঞ্চল ।
একই বিষয়ের উপর তারা বেশিক্ষন মন স্থির রাখতে পারে না। তাদের মন খুব দ্রুত এক দৃশ্য থেকে দৃশ্যান্তরে ছুটে যায়। সবকিছুতেই তাদের মনে কৌতুহল, জানার ও দেখার আগ্রহ প্রবল। প্রশ্নের পর প্রশ্ন তাদের চোখে মুখে। অন্যদিকে বড়দের মন ও চিন্তা বাস্তবের নির্মম কষাঘাতে স্থবির ও স্থুল। যারা বয়স্ক হয়েও শিশু মনের অধিকারী, শিশুদের মনোজগতে বিচরণ করেন কেবল তারাই শিশুদের মনের উপযোগী, ভালো লাগার মত সাহিত্য রচনা করতে পারেন। ইব্রাহিম বাহারী তেমনি একজন বিশেষজ্ঞ শিশু মনের অধিকারী শিশু সাহিত্যিক।
তার হাত থেকে ঝরছে শিশুতোষ ছড়া, কবিতা, গল্প ও উপন্যাস। ইতিপূর্বে তার রচিত দুটি ছড়া গ্রন্থ ‘স্বর্ণলতা’ ও ‘হাজার পাখির দেশ’ পাঠকপ্রিয়তা লাভ করেছে। এরপর প্রকাশিত তার এই চড়ুইভাতি অনেক মজার ছড়া নিয়ে এসেছে।
গ্রন্থের সর্বপ্রথমে মহান আল্লাহর প্রশংসা করে লেখা একটি ছড়া “তার নামে” স্থান পেয়েছে।
নিটোল ছড়াটি কবি এভাবে শুরু করেছেন-
আসমান জমিন নিখিল ধরাধামে
গাছপালা তরুলতা গায় তার নামে।
পশুপাখি মানুষের যোগান আহার
তার নামে বাঁচা মরা সবই তাহার।
(তার নামে, পৃষ্ঠা ৫)
আসমান জমিনে যা কিছু আছে সবই আল্লাহ তায়ালার সৃষ্টি। তিনি জীবনদাতা, মৃত্যুদাতা এবং সবার রিজিকের মালিক। আমাদের সবার সকল কাজ শুরু করার আগে আল্লাহতালার প্রশংসা ও তার সাহায্য চেয়ে শুরু করা উচিত। কবি এই ছড়াটিতে সেই শিক্ষা দিতে চেয়েছেন।
কিছুকাল পূর্বেও ছড়ার বিষয়, উপাত্ত ও গণ্ডি ছিল খুব সীমিত। শুধু শিশুদের মন ভুলানো ও ঘুম পাড়ানোর ছড়া রচিত হতো। সময়ের সাথে ছড়ার অনেক পরিবর্তন এসেছে। এখন ছড়ায় এসেছে নানা বিষয়। বড়দের জন্য ছড়া লেখা হচ্ছে । ছড়া খুবই জনপ্রিয় এবং গতিশীল। শিক্ষিত অশিক্ষিত মাঠের চাষীর, ঘাটের মাঝি, সবার মুখে ছড়া শোনা যায়।
সমাজের অন্যায়, অনাচার, অবিচার, দুর্নীতি, জোর জুলুম ও সকল অপরাধের বিরুদ্ধে ছড়াকাররা এখন ছড়ার হাতিয়ার নিয়ে সোচ্চার হয়ে উঠেছেন। আমাদের দেশের অনেক নবীন-প্রবীণরা এখন ছড়া লিখছেন । বাংলা ছড়া সাহিত্য এখন অনেক সমৃদ্ধ। ইব্রাহিম বাহারীর চড়ুইভাতি পড়ে মনে হয় তিনি মনে-প্রাণে একজন শিশু সাহিত্যিক। শিশুদের রঙিন মনের সকল স্বভাব ও অলি-গলি তার জানা আছে।
একজন শিশুর কাছে বয়সে কম বেশি, ছোট বড় শিশু বা বৃদ্ধের মধ্যে কোন পার্থক্য নেই। তাদের কাছে সবাই সমান। তাই নাতি তার দাদুকে বলতে পারছে-
ও দাদুভাই ও দাদুভাই খেলতে যাব মাঠে
উদোম রাতে পুকুর ঘাটে ফুল পাখিদের হাটে।
ফুলের হাটে ফুল পরীরা আমার খেলার সাথী
তাদের সাথে খেলায় মাতি করিনা বজ্জাতি।
তুমি যদি আমার সাথে খেলার ইচ্ছে করো
দৌড়ে এসো লাটাই হাতে আমার পিছু ধরো।
(দাদা ও নাতি, পৃষ্ঠা -৬)
এই তো শিশুর স্বভাব ও ব্যবহার। দাদুকে তার খেলার সাথী বানাতে টানাটানি করছে।
বাংলাদেশ ষড়ঋতুর দেশ। রীতিতে রীতিতে বিচিত্র রূপ সুষমা। গ্রীষ্ম, বর্ষা ,শরৎ, হেমন্ত, শীত, বসন্তের সৌন্দর্য সম্মান নিয়ে আসে শিশুরা। এই ঋতু বৈচিত্র দারুন ভাবে উপভোগ করে শিশুদের এই মনের স্বভাব জানা আছে। তাই তিনি ছড়া লিখে বাচ্চাদের মনের খোরাক দিয়ে রেখেছেন। গ্রন্থের পাতায় পাতায় ফুল পাখি, প্রজাপতি, খেজুর রস, তালের পিঠা, কলার ভেলা, কাগজের নৌকো এবং এমনকি মজার নাগরদোলার কথা ছড়ায় আনতে ভোলেননি। বারো মাসের ছড়াটি দারুণ চমৎকার। ছড়াটি মুখস্থ করলে বারো মাসের ১২ নামের সঙ্গে প্রকৃতির বারোটি রূপ জানা হয়ে যাবে।
পৌষ মাসে শীতের বুড়ি খেজুর রসের মজা
মাঘ মাসে খেতে ভালো টাটকা মন্দা গজা।
ফাগুন মাসে আগুন ধরে কৃষ্ণচূড়ার হাটে
চৈত্র মাসের খরায় মাঠে সবুজ জমির ফাটে।
(১২ মাসের ছড়া, পৃষ্ঠা ৮)
শিশুদের কাছে নানারকম রঙ্গ রসের ছড়া বলার সাথে সাথে চির কিশোর, চির তরুণ, অন্যায়ের বিরুদ্ধে বিদ্রোহী বিপ্লবী আমাদের জাতীয় কবির ছেলেবেলার পরিচয় তুলে ধরেছেন। কিন্তু তার নামটি উল্লেখ না করে কৌশলে প্রশ্ন করেছেন: যে ছেলেটা করাচিতে যুদ্ধ করে/ হলেন হাবিলদার/ বর্ধমানের দস্যি ছেলে/ কি নাম যেন তার? (কি নাম জানো তার, পৃষ্ঠা ১৪)
শিশুদের শুধু খেলাধুলা এবং ছোটাছুটির মধ্যে মাতিয়ে রাখা নয়, তাদের নৈতিক শিক্ষা ও মানুষ গঠনের জন্য লেখাপড়া বই পড়ায় মনোযোগী হওয়ার উপায় উপকরণের কথা বলা হয়েছে ছড়ায়-
নামাজ পড়ো আজান হলে
থাকিও পাক সাব
দুহাত তুলে রবের কাছে
চাও গো গুনাহ মাফ।
অশ্লীলতা মন্দ যত
দেয় সরিয়ে নামাজ
খোদার হুকুম করলে পালন
সুখের হবে সমাজ।
(নামাজ, পৃষ্ঠা ২৪)
আমাদের আছে গৌরবময় স্বাধীনতার ইতিহাস বীরত্ব সাহস ও সৌর্যবীর্য ইতিহাস। সকল অন্যায় অনাচার, অবিচার, দুর্নীতি ও অসমতার বিরুদ্ধে যুদ্ধ করে জীবন দিয়ে আমরা স্বাধীনতা অর্জন করেছি। কিন্তু দুঃখের বিষয় এখনো আমরা স্বাধীনতার সেই সুখ ও অধিকার পাচ্ছি না। শিশুদের সেই স্বাধীনতা সংগ্রামের কথা এবং বর্তমানে আমাদের হতাশা ও দুঃখের কথা ও দেশের অবস্থা মনে করিয়ে দিয়ে নবীনদের সচেতন করে তোলার চেষ্টা করেছেন “হায়রে স্বাধীন দেশ” ছড়াটিতে। ইব্রাহিম বাহারী শিশুদের সমাজ স্বদেশ এবং নিজের অধিকার সম্পর্কে সচেতন করে তোলার জন্য বলেছেন:
ত্যাগ তিতিক্ষার নয়টি মাসের
ফসল স্বদেশ স্বাধীন
পাক সেনাদের তাড়িয়ে গর্বে
নাচতে ছিলাম তাধিন।
পাক সেনাদের বর্গী গেল
দেশ থেকে ঠিক সত্য
এই দেশে জন্ম নিল
রাঘব বোয়াল যত্ত।
তাদের গায়ে চুনোপুটির
জীবন থাকতে শেষ
২৬ শে মার্চ ২৬ শে মার্চ
হায়রে স্বাধীন দেশ।
(হায়রে স্বাধীন দেশ, পৃষ্ঠা -১৫)
শিশুরা তো মুক্ত পাখির মত যেদিক ইচ্ছে সেদিকেই ছুটে যেতে চায়। তারা চিন্তাভাবনা দ্বিধা দ্বন্দ্বহীন। সংখ্যা ভয়-ভীতিহীন। এমন স্বভাবের শিশুদের কিছু দিকনির্দেশনা দেয়া প্রয়োজন মুরুব্বিদের। সঠিক কাজের এবং সঠিক পথের চেতনা মনের ভেতর জাগিয়ে দেয়া বড়দের বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব। ইব্রাহিম বাহারী খুব সচেতন, শিশু মনোবিজ্ঞানী. শিশুদের প্রতি তার সেই দায়িত্ব পালন করেছেন- ‘জাগো সোনা’ ছড়াটিতে। শিশুদের চিন্তা ও কর্মের সচেতন করে তোলার জন্য, ভালো সুন্দর মানুষ হওয়ার জন্য দেশ ও জাতি গঠনের দায়িত্ব সম্পর্কে সচেতন করে তোলার জন্য, অন্যায় অনাচার অবিচার জোর জুলুম ও দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার হওয়ার জন্য আহ্বান জানিয়েছেন আন্তরিকতার সঙ্গে আবেগময় ভাষায়। শিশুরাই দেশ ও জাতির ভবিষ্যৎ। ইব্রাহিম বাহারী তাই তাদের উদ্দেশ্যে বলেছেন-
জাগো সোনা তোলা ফল
ভয়ের কিছু নাই,
তোমরা হবে দেশের মাথা
সোনা মানিক ভাই।
বেরুয়ে এসো নবীন তরুণ
জ্ঞানের মশাল জ্বালো
তোমরা হবে যুগের নকীব
বিশ্ব করো আলো।
বেরিয়ে এসো আধার থেকে
আলোর পথে ছোটো
বিশ্বজাহান জয় কর ভাই
ফুল হয়ে সব ফোটো।
(জাগো সোনা, পৃষ্ঠা- ৭)
মুহাম্মদ ইব্রাহিম বাহারীর চড়ুইভাতি সর্বাঙ্গ সুন্দর নিটোল একটি শিশুতোষ ছড়াগ্রন্থ। এর মধ্যে শিশু মনের চিন্তা দশ দিকের খোরাকি রয়েছে এবং সেই সঙ্গে দেশের ঋতু বৈচিত্র শস্য শ্যামল মাঠঘাট নদ নদী বিল ঝিল পশুপাখির কোলাহল মুখরিত মনোরম পরিবেশ ছবির মত ফুটে উঠেছে। ছড়াগুলোর শব্দ ছন্দে ও ছবিতে চড়ুইভাতি শিশু কিশোররা পাঠ করে তো আনন্দ পাবেই। বড়রা পাঠ করে খুশি হবেন। এমন নিটল সুন্দর ছড়াগ্রন্থ উপহার দেয়ার জন্য ইব্রাহিম বাহারীকে অনেক অনেক মোবারকবাদ জানাচ্ছি। বাংলা ছড়া সাহিত্যে চড়ুইভাতি অবশ্যই একটি উল্লেখযোগ্য সংযোজন তাদের সন্দেহ নেই। এমন রুচিশীল ছড়াগ্রন্থ বেশি বেশি গঠিত হলে ছাত্র-ছাত্রীদের টেবিলে রাখলে সবাই সুফল পাবেন তা সহজেই আশা করা যায়।