৩০ ডিসেম্বর, ২০২৩ ১৩:০৫ পি এম
শেষ হতে চলেছে ২০২৩ সাল। এ বছর সাহিত্য সাংস্কৃতিক অঙ্গনের বহু গুণী ও প্রিয় মানুষেরা পৃথিবী ছেড়ে চলে গেছেন। প্রয়াত এসব গুনীজনের ভালো কাজগুলোই জীবিত থাকবে আজীবন। এগুলোর মাধ্যমেই বেঁচে থাকবেন তারা। তাদেরকে হারানোর শোক হৃদয়ে নিয়েই বরণ করতে হবে নতুন বছরকে। কালচারাল টাইমসের ‘ফিরে দেখা-২০২৩’ আয়োজনে হারানো এসব মানিকদের নিয়ে আলোচনা তুলে ধরছি।
সুফিয়া খাতুন, লেখিকা
লেখিকা সুফিয়া খাতুন ২০২৩ সালের ৭ই জানুয়ারি মৃত্যুবরণ করেন। ‘আত্মজীবনী/স্মৃতিকথা/ভ্রমণকাহিনী’ শ্রেণীতে বিশেষ অবদানের জন্য তিনি ২০২১ সালে বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার অর্জন করেন। তিনি ১৯৫০–এর দশক থেকে শুরু করে ২৩ বছর তিনি সিদ্ধেশ্বরী গার্লস স্কুল, ভিকারুননিসা নূন স্কুল ও তৎকালীন ক্যান্টনমেন্ট মডার্ন স্কুলে শিক্ষকতা করেন। শত বয়সী এ লেখিকা ১৯২২ সালের মে মাসে ময়মনসিংহে জন্মগ্রহণ করেছিলেন। তার উল্লেখযোগ্য গ্রন্থগুলো হলো- সোনা ঝরা দিন, আপনভূবন, প্রবাসের প্রাপ্তি, নারীর চোখে জল।
খালেকুজ্জামান, অভিনেতা
২১ মার্চ মারা গেছেন টিভি নাটক ও চলচ্চিত্রের অভিনয়শিল্পী বীর মুক্তিযোদ্ধা খালেকুজ্জামান। মৃত্যুকালে তাঁর বয়স হয়েছিল ৭৩ বছর। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ১৯৭৪ সালে নাট্য ও চারুকলায় স্নাতকোত্তর ডিগ্রি লাভ করেন তিনি। দীর্ঘ ক্যারিয়ারে প্রায় ৩০০ নাটকে অভিনয় করেছেন খালেকুজ্জামান। ১৯৭৫ সালে বিটিভির তালিকাভুক্ত শিল্পী হন তিনি।
শামীম শিকদার, ভাস্কর্য শিল্পী
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের চারুকলার শিক্ষক ও বিখ্যাত ভাস্কর্য শিল্পী শামীম সিকদার ২২ মার্চ মারা গেছেন। ১৯৮৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসির পাশে ‘স্বোপার্জিত স্বাধীনতা’ ভাস্কর্য, জগন্নাথ হলের সামনে ‘স্বাধীনতার সংগ্রাম’ ভাস্কর্যটি তারই করা। কাজের স্বীকৃতি স্বরূপ ২০০০ সালে একুশে পদক পান তিনি। ১৯৫২ সালের ২২ অক্টোবর তিনি বগুড়ার মহাস্থানগড়ে জন্মগ্রহণ করেছিলেন।
খালেদা মনযূর-এ-খুদা, লেখিকা
ভাষাসৈনিক ও লেখিকা খালেদা মনযূর-এ-খুদা ২৪ মার্চ মারা যান। ভাষা আন্দোলনে অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তাঁকে ২০২৩ সালে একুশে পদকে ভূষিত করা হয়। তিনি ১৯৩২ সালে পশ্চিমবঙ্গের চব্বিশ পরগনা জেলার কাজীপাড়া গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন। ভাষাসৈনিক ও লেখক পরিচয়ের পাশাপাশি তিনি ছিলেন গায়িকা, শিক্ষক, সমাজসেবী ও টেলিভিশন উপস্থাপিকা। তাঁর লেখা কয়েকটি গ্রন্থ হলো—চীনকে চিনে এলাম, আপন ভুবনে, আশ্রয় চাই, আশা না পুরিলো, কানা গলির শেষ বাড়িটা।
শহিদুল হক খান, চলচ্চিত্রকার
চলচ্চিত্র লেখক, পরিচালক এবং গীতিকার শহিদুল হক খান ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়ে ১৯ এপ্রিল মারা যান। ১৯৯০ সালের চলচ্চিত্র ছুটির ফান্দেতে গীত রচনার সুবাদে তিনি বাংলাদেশ জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার শ্রেষ্ঠ গীতিকার এর পুরস্কার লাভ করেন।
ফারুক, অভিনেতা
বাংলা চলচ্চিত্রের অভিনেতা সংসদ সদস্য আকবর হোসেন পাঠান ফারুক ১৫ মে মৃত্যুবরণ করেন। ১৯৪৮ সালের ১৮ আগস্ট গাজীপুরের কালীগঞ্জ উপজেলায় জন্মগ্রহণ করেন। এইচ আকবর পরিচালিত ‘জলছবি’ চলচ্চিত্রে অভিনয়ের মধ্য দিয়ে ১৯৭১ সালে ঢাকাই সিনেমায় তাঁর অভিষেক ঘটে। তিনি ২০০৬ সালে বাচসাস পুরস্কার এবং ২০১৬ সালে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কারে আজীবন সম্মাননা পুরস্কার অর্জন করেন।
মোহন খান, নাট্য নির্মাতা
৩০ মে প্রয়াত হন নাট্য নির্মাতা মোহন খান। তার মৃত্যুতে নাট্য জগতে শোকের ছায়া নেমে আসে। তার উল্লেখযোগ্য নাটকের মধ্যে আছে সমুদ্রে গাংচিল, গাংচিল ভালোবাসা, জোনাকীর গল্প, দূরের মানুষ, মধ্যরাতের অশ্বারোহী, বেলাভূমি, সমুদ্র সীমানায়।
পান্না কায়সার, লেখিকা
লেখিকা, গবেষক, শিশু সংগঠক, সাবেক সংসদ সদস্য পান্না কায়সার ৪ আগস্ট ইন্তেকাল করেন। শহীদ বুদ্ধিজীবী শহীদুল্লা কায়সারের স্ত্রী ছিলেন পান্না কায়সার। তিনি অভিনেত্রী শমী কায়সারের মা। লেখালেখির জগতে পান্না কায়সারের প্রবেশ ১৯৯১ সালে। তাঁর প্রথম গ্রন্থ ‘মুক্তিযুদ্ধ: আগে ও পরে’। তাঁর অন্য গ্রন্থগুলোর মধ্যে রয়েছে—মুক্তি, নীলিমায় নীল, হৃদয়ে একাত্তর, আমি ও আমার মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধ-সমগ্র, একাত্তরের শহীদ শহীদুল্লা কায়সার, মুক্তিযুদ্ধের কথকতা, হৃদয়ে বাংলাদেশ প্রভৃতি। মুক্তিযুদ্ধভিত্তিক গবেষণায় অবদানের স্বীকৃতি হিসেবে পান্না কায়সার বাংলা একাডেমি সাহিত্য পুরস্কার ২০২১ পেয়েছিলেন।
দেলোয়ার হোসাইন সাঈদী, বক্তা ও লেখক
বিশ্ববরেণ্য ইসলামি পণ্ডিত, লেখক ও সাবেক সংসদ সদস্য আল্লামা দেলোয়ার হোসাইন সাঈদী ১৪ আগস্ট রাতে কারাবন্দি অবস্থায় ইন্তেকাল করেন। বাংলা ছাড়াও ইংরেজি, উর্দু, আরবি, পাঞ্জাবি ও ফরাসি ভাষায় দক্ষ ছিলেন তিনি। লেখালেখিতেও তিনি ছিলেন সিদ্ধহস্ত। তিনি ৫০-এর অধিক মৌলিক গ্রন্থ রচনা করেন। তার লেখা গ্রন্থগুলোর মধ্যে আখিরাতের জীবনচিত্র, দুর্নীতি মুক্ত সমাজ গড়ার মূলনীতি, আমি কেন জামায়াতে ইসলামী করি, সন্ত্রাস ও জঙ্গীবাদ দমনে ইসলাম, কাদিয়ানীরা কেন মুসলমান নয়, নীল দরিয়ার দেশে, ঈমানের অগ্নিপরীক্ষা, হাদীসের আলোকে সমাজ জীবন, তাফসীরে সাঈদী, আল্লামা সাঈদী রচনাবলী, সীরাতে সাইয়্যেদুল মুরসালীন, নন্দিত জাতি নিন্দিত গন্তব্যে অন্যতম। দেলাওয়ার হোসেন সাঈদী ১৯৪০ সালের ২ ফেব্রুয়ারি পিরোজপুরের ইন্দুরকানীর বালিপাড়া ইউনিয়নের সাঈদখালি গ্রামে জন্মগ্রহণ করেন।
আফজাল চৌধুরী, চিত্রগ্রাহক
৩১ আগস্ট প্রয়াত হন কালজয়ী চলচ্চিত্র ‘জীবন থেকে নেয়া’র কিংবদন্তী চিত্রগ্রাহক আফজাল চৌধুরী। নির্মাতা জহির রায়হানের সিনেমা ‘কাঁচের দেয়াল’ এর মাধ্যমে চিত্রগ্রহণে কাজ শুরু করেন। এছাড়াও তিনি কাজ করেন সঙ্গম, বাহানা, আয়নার মতো চলচ্চিত্রে। ৯২ বছর বয়সে বার্ধ্যক্যজনিত কারণেই মৃত্যু হয় তার।
সোহানুর রহমান সোহান, চলচ্চিত্র পরিচালক
১৩ সেপ্টেম্বর মারা যান চলচ্চিত্র পরিচালক সোহানুর রহমান সোহান। নিজ বাসায় ঘুমের মধ্যে মৃত্যু হয় এই পরিচালকের। চলচ্চিত্রের নির্মাতা সোহানুর রহমান সোহান পরিচালিত প্রথম চলচ্চিত্র 'বিশ্বাস অবিশ্বাস'। এ নির্মাতার হাত ধরেই চলচ্চিত্রে আসেন সালমান শাহ, মৌসুমী, পপি ও ইরিন জামান। শাকিব খান অভিনীত প্রথম মুক্তিপ্রাপ্ত 'অনন্ত ভালোবাসা' সিনেমার পরিচালকও ছিলেন তিনি।
মোহাম্মদ রফিক, কবি
কবি মোহাম্মদ রফিক ৬ আগস্ট বরিশাল থেকে ঢাকা ফেরার পথে মৃত্যুবরণ করেন। তার জন্ম ২৩ অক্টোবর ১৯৪৩ সালে বাগেরহাটে। ২০১০ সালের একুশে পদকপ্রাপ্ত এ কবি জাহাঙ্গীরনগর বিশ্ববিদ্যালয়ের ইংরেজি বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ছিলেন। ১৯৭০ সালে তার প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘বৈশাখী পূর্ণিমা’ প্রকাশিত হয়। তার একাধিক কাব্যগ্রন্থ রয়েছে। কবিতার পাশাপাশি তার গদ্যগ্রন্থের মধ্যে রয়েছে ভালবাসার জীবনানন্দ, আত্মরক্ষার প্রতিবেদন ও স্মৃতি বিস্মৃতির অন্তরাল। বাংলা সাহিত্যে অবদানের জন্য ১৯৮৭ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার ও ১৯৮১ সালে আলাওল পুরস্কার পান মোহাম্মদ রফিক।
সৈয়দ সালাহউদ্দিন জাকী, চলচ্চিত্র নির্মাতা
গত ১৯ সেপ্টেম্বর প্রয়াত হন কালজয়ী ‘ঘুড্ডি’ খ্যাত নির্মাতা সৈয়দ সালাহউদ্দিন জাকী। ১৯৮০ সালে ‘ঘুড্ডি’ সিনেমা দিয়ে দর্শকদের মন জয় করেছিলেন তিনি। এই সিনেমার জন্য তিনি শ্রেষ্ঠ সংলাপ রচয়িতা হিসেবে জাতীয় চলচ্চিত্র পুরস্কার পান। ২০২১ সালে একুশে পদক লাভ করেন জাকী।
জিনাত বরকতুল্লাহ, নৃত্যশিল্পী
নৃত্যশিল্পী জিনাত বরকতউল্লাহ ২০ সেপ্টেম্বর রাজধানীর একটি হাসপাতালে মারা যান। তার মেয়ে অভিনয়শিল্পী ও নৃত্যশিল্পী বিজরী বরকতউল্লাহ। ১৯৮০ সালে জিনাত বরকতউল্লাহ বিটিভির নাটক ‘মারিয়া আমার মারিয়া’ দিয়ে অভিনয়জীবন শুরু করেন। জিনাত বরকতউল্লাহ নৃত্যশিল্পে অবদানের জন্য ২০২২ সালে একুশে পদক পেয়েছেন। ১৯৫২ সালের ৩ অক্টোবর কুমিল্লায় জন্মগ্রহণ করেন।
আসাদ চৌধুরী, কবি
কবি আসাদ চৌধুরী ৪ অক্টোবর কানাডার টরন্টোর একটি হাসপাতালে মারা যান। প্রথম কবিতার বই ‘তবক দেওয়া পান’-এর মাধ্যমে পরিচিতি পান কবি। কবিতার পাশাপাশি শিশু সাহিত্য, প্রবন্ধ, ইতিহাসগ্রন্থ, অনুবাদগ্রন্থ রচনা করেছেন তিনি। সাহিত্যে অবদান রাখায় ১৯৮৭ সালে বাংলা একাডেমি পুরস্কার এবং ২০১৩ সালে একুশে পদক ছাড়াও একাধিক পুরস্কারে ভূষিত হন তিনি। আসাদ চৌধুরী ১৯৪৩ সালের ১১ ফেব্রুয়ারি তৎকালীন বাকেরগঞ্জ জেলার মেহেন্দিগঞ্জে জন্মগ্রহণ করেন।
আজিজুর রহমান আজিজ, লেখক
সাবেক সচিব, দেশের প্রথম প্রধান তথ্য কমিশনার, কবি, গীতিকার ও ঔপন্যাসিক আজিজুর রহমান আজিজ ৯ অক্টোবর মারা যান। শৈশবে কবিতা ও ছড়া লেখা দিয়ে তার লেখালেখির যাত্রা শুরু হলেও ধীরে ধীরে তিনি কবিতার পাশাপাশি গল্প, উপন্যাস, গান রচনা করে বাংলাদেশের বিভিন্ন গণমাধ্যমে আত্মপ্রকাশ করেন। তিনি ১৯৪৪ সালের ১০ই জানুয়ারি মাদারীপুর জেলায় জম্নগ্রহণ করেন।
শফি বিক্রমপুরী, চলচ্চিত্রকার
খ্যাতনামা চলচ্চিত্রকার ও রাজনীতিবিদ শফি বিক্রমপুরী ১৮ অক্টোবর মারা গেছেন। ১৯৬৫ সালে দক্ষিণাঞ্চলের লোকজ প্রেমকাহিনী অবলম্বনে নির্মিত ‘গুনাই বিবি’ সিনেমাটি যৌথ প্রযোজনার মাধ্যমে তিনি প্রযোজক হিসেবে আত্মপ্রকাশ করেন। ১৯৭৮ সালে সম্পূর্ণ রঙিন সিনেমা ‘রাজদুলারী’র মাধ্যমে পরিচালক হিসেবে তার অভিষেক ঘটে। ঢাকার স্মৃতিকথা নিয়ে ‘ঢাকায় ৫০ বছর’ নামে একটি বই লিখেছেন তিনি। বইটি ২০০৮ সালে প্রকাশ পায়। ১৯৪৩ সালের ৪ জুলাই মুন্সীগঞ্জ জেলার শ্রীনগর থানার মত্তগ্রামে জন্মগ্রহণ করেন শফি বিক্রমপুরী।
সুজিত রায়, সংগীতশিল্পী
স্বাধীন বাংলা বেতারের শব্দসৈনিক সংগীতশিল্পী সুজিত রায়। চলতি বছরের ২৩ অক্টোবর রাতে প্রয়াত হন তিনি।
নূর মোহাম্মদ, চলচ্চিত্র পরিচালক
৪ ডিসেম্বর মারা যান বিশিষ্ট চলচ্চিত্র পরিচালক বীর মুক্তিযোদ্ধা নূর মোহাম্মদ। রাজধানীর একটি হাসপাতালে তিনি মারা যান। তিনি ১৯৯৮ সালে পরিচালক হিসেবে ঢালিউড সিনেমায় পা রাখেন। তার পরিচালিত প্রথম সিনেমা ‘ঘাটের মাঝি’ সুপারহিট হয়।