২৭ নভেম্বর, ২০২৩ ১২:২০ পি এম
১৩ রজব, ইরানে জাতীয় ছুটির দিন। বেশ আনন্দ উদ্দীপনার মধ্য দিয়ে কাটে দিনটি। ছুটির অবকাশে মিষ্টি আর উপহারমুখর দিনটি বিশেষ করে বাবাদের জন্য একেবারেই অন্যরকম ভালো লাগার আমেজ নিয়ে আসে। সারা বছর তো সন্তানেরা বাবার কাছ থেকে নানা উপহার পায়, বাবারা সাধারণত পায় না। আজ উল্টো-বাবা পায় সন্তানের কাছ থেকে। যত দূরেই থাকুক বাবা, দূরত্ব ঘুচিয়ে সন্তানেরা শ্রদ্ধা আর ভালোবাসার পসরা মেলে ধরে এইদিন। আমাদের ছোট সাহেব সামি এবং লিটল প্রিন্সেস অর্মিতাও খুব সকালেই তাদের ভালোবাসা মেলে ধরেছে আমার বুকের ক্যানভাসে। শুয়ে ছিলাম। দু’জনই একে একে তাদের ভালোবাসার রঙে আঁকা শিল্পকর্ম এনে বুকের ওপর রেখে বললো: ‘হ্যাপি ফাদার্স ডে বাবা’!
- থ্যাংক ইউ
সমস্বরে দু’জনই ওয়েলকাম জানিয়ে অপেক্ষা করতে লাগলো।
হযরত আলীর (রা.) জন্মদিন আজ। ইরান এই দিনটিকে ‘রুজে পেদার’ বা ফাদার্স-ডে হিসেবে উদযাপন করে। বাচ্চাদের শুভেচ্ছা নিতেই ফিরে গেলাম ১৯০৮ সালের ৫ জুলাইতে। ঔচিত্যের দাঁড়িপাল্লা আড়াল থেকে সহসা সামনে এসে দাঁড়িয়ে গেল।
আমি বেডরুম ওয়ারড্রোবের ড্রয়ার টেনে দু’জনের হাতেই চকোলেট বার তুলে দিতে দিতে জিজ্ঞেস করলাম: তোমরা কি জানো ‘ফাদার্স-ডে’ কবে থেকে কারা পালন করেছিল?
- না বাবা! সমস্বরে। স্কুলে পালন করে।
: হুমম
- তুমি বলো না বাবা!
: আমেরিকার ওয়েস্ট ভার্জিনিয়া অঙ্গরাজ্য আছে না?
- হুমম
সেখানে মাইন দুর্ঘটনায় শতাধিক মানুষ মারা গিয়েছিল। মৃতদের সন্তানের একজন প্রথমবারের মতো ফাদার্স ডে পালনের প্রস্তাব দিয়েছিল। তার অনেক পরে ১৯৬৬ সালে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট লিন্ডন জনসন ফাদার্স ডে-কে ছুটির দিন ঘোষণা করলে মার্কিনীরা দিনটিকে ঘটা করে উদযাপন করে। তারপর থেকে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশে বিভিন্ন তারিখে এই ফাদার্স-ডে পালিত হয়ে আসছে।
: আমেরিকায়ও আজ ফাদার্স-ডে
- না, না!
: তারা কবে পালন করে বাবা!
- জুন মাসের তৃতীয় রোববার।
: ইরানে কেন সেদিন পালন করে না বাবা?
- ইরানে ‘ইসলামিক রিপাবলিক’ বাবা! এখানে হযরত আলির (রা.) জন্মদিনকে বাবা-দিবস হিসেবে পালন করে। মা-দিবস পালিত হয় হযরত ফাতিমার (রা.) জন্মদিনে।
বলতে বলতে তাদের দেওয়া উপহারগুলো দেখছিলাম। দেখতে দেখতে বললাম: চমৎকার এঁকেছো তোমরা। চলো, এখন নাশতা করি সবাই। নাশতার টেবিলে বসে তাদের উপহারের বাকি জবাব দিতে হলো: খুব ভালো হয়েছে। আমি ভীষণ খুশি হয়েছি।
এবার তারা তাদের শিল্পকর্ম তৈরির নেপথ্যের কাহিনী কসরতের বর্ণনা দিলো। আমি খুব মনোযোগের সঙ্গে শুনে শিল্পকর্মের ইতিহাস সচেতন হয়ে উঠলাম। নাশতার টেবিলেই তারা কিচির মিচির করে কে কার আগে কী বলবে না বলবে, মাথার ভেতর ঘূর্ণিঝড় বইয়ে দিলো। মাথা আমার ঘুরছে। বাবা দিবস বলে কথা। আজ তাদের কিচ্ছু বলা যাবে না। দুজনই সমস্বরে বলে উঠলো: বাবা! আজ তোমার কি অফ ডে? মিডিয়ার একটা সমস্যা হলো পৃথিবীর সকল ঝড়Ñঝঞ্ঝা একদিকে, অফিস আরেকদিকে। কিয়ামতের পূর্ব মুহূর্ত পর্যন্ত যান্ত্রিক ত্রæটি ছাড়া রেডিও কিংবা টেলিভিশন বন্ধ হবে কিনা সন্দেহ। ওরা সবাই জানে ব্যাপারটা। অভিজ্ঞতায় তারা দেখেছে সরকারি বন্ধের দিনেও বাবা অফিসে যায়। সেজন্য তারা নিশ্চিত হতে চাইলো আমার আজ অফিস আছে কিনা! আমি হুট করেই জবাবটা দিলাম না। সবাইকে একটু ঘোরের মধ্যে রেখে দিলাম। বড় মামনি-প্রিন্সেস উপমা-মৌনতা ভেঙ্গে আবারও বললো: বাবা! বলছো না যে...
: হুমমম, অফিসে.....যাচ্ছি..... না.........
- হুররে.....
তিনজনই সমস্বরে চিৎকার করে উঠলো। তাদের এক সমুদ্র আনন্দের ঢেউ উথলে পড়লো আমার স্নেহের পলিময় উপক‚লে। বললাম: অ্যাতো খুশির কী কারণ...
ওরা পরস্পরের দিকে তাকিয়ে খানিক চুপ থেকেই কোরাস কণ্ঠ-সঙ্গীত বাজালো: “ হা ...হা হা.. হা হা হা হা... কিছুক্ষণ খোলা গলায়, কিছুক্ষণ হামিং... ”
এটা তাদের আনন্দ প্রকাশের নিজস্ব ভঙ্গি। ওরা জানে ছুটি পেলেই বাবা তাদের কোথাও না কোথাও বেড়াতে নিয়ে যায়। সেই অজানা নগরে যাবার নিশ্চিত খুশিতেই তারা উচ্ছ¡লিত, আবেগে উদ্বেলিত।
অর্মিতা বলেই বসলো: বাবা! আমরা আজ কোথায় যাচ্ছি...
- কোত্থাও না... আব্বুর আজ ছুটি, শুধু ঘুমোবো। চাইলে তোমরাও ঘুমোতে পারো আমার সাথে...
ওরা তিনজনই হেসে কুটিকুটি। যেন এক্ষুণি ডাইনিং চেয়ার থেকে পড়ে ফ্লোরে লুটোপুটি খাবে। কোনো কারণ ছাড়াই অনেক সময় বাচ্চারা হাসে। হাসির একটা জোয়ার ভাটা আছে। যখন জোয়ার আসে তখন আসতেই থাকে...। কী শুনে হাসছে তা গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বের ব্যাপারটি হলো হাসতে হবে... চোখাচোখি হলেও হাসবে। বকা দিলেও হাসবে। আমি বকা দিলে ওরা খুব হাসে। বাবার বকায় উল্টো ফল হয়। মায়ের বকুনিটা অবশ্য আশু ফলপ্রদ।
- তোমাকে ঘুমাতে দেবো না... হাহ হাহ হা
একে একে সবাই একই কথা বললো প্রতিধ্বনির মতো। উপমা একবার দু’জনের দিকে তাকালো। ওদের কিছু সাংকেতিক ভাষা আছে। চোখ-মুখের সেই ভাষা তারা ঠিকঠাকমতো পড়ে ফেলে। আমি কোনোভাবেই ওই ভাষার বর্ণমালাগুলো শিখতে পারিনি আজও। তিনজনই একসঙ্গে আমার পেছন দিয়ে এসে দুই কপোল আর কপালে চুমোয় চুমোয় ভরে দিলো। চুমু দিতে দিতে বললো: প্লি......জ বাবা! বলো না কোথায় যাবো...?
আমি আমার উত্তমাংশের দিকে-সোহাগি-তাকালাম। বললাম: ওকে...
এটুকু বলতেই আবারও হুররে... ধ্বনির কোরাস তুললো তারা।
- ওকে ডোন্ট শাউট...! বলো! কোথায় যেতে চাও তোমরা।
- তিনজনই একেক করে বললো: তুমি যেখানে নিয়ে যাবে...
আমি একবার মোবাইলে আবহাওয়ার পূর্বাভাসটা দেখে নিলাম। এ মুহূর্তে যদিও রোদ, তবে শেষ বিকেলের দিকে হালকা বৃষ্টি হতে পারে। ভাবলাম যেতে হলে এক্ষুণি বেরিয়ে পড়তে হবে। বললাম: সবাই রেডি হয়ে নাও.. কুইক!
হুড়মুড় করে যে যার মতো প্রস্তুতি নিতে শুরু করলো। সোহাগিকে বললাম: আমি স্যান্ডুইচ নিয়ে আসছি। তুমিও রেডি হয়ে নাও।
- কোথায় যাচ্ছো। সোহাগি জানতে চায়।
: ললে মানে টিউলিপ বাগান দেখতে যাবো। ওখানে তাঁবু খাটানো যাবে না। তবে অলচিকে মানে নিকুঞ্জ বা ছাউনিতে বসে খাওয়া সেরে নেওয়া যাবে। বৃষ্টি এলেও সমস্যা নেই।
বলেই আমি গাড়ির চাবি নিয়ে বেরিয়ে পার্কিংয়ে চলে গেলাম। সুইচ অন করতেই ছোট সাহেব এসে হাজির। বাবা স্টিয়ারিংয়ে বসলেই হলো। যেখানেই থাকুক সামি আসবেই এবং আমার সঙ্গে বেরুবেই। সুতরাং ‘না’ বললাম না। পার্কিংয়ের অটো গেইটের রিমোট-বাটনে চাপ দিতেই গেইট খুলে গেল। আমরা বেরিয়ে চলে গেলাম স্পেশাল স্যান্ডুইচ হাউজে। ইরানের ওপেন ইউনিভার্সিটির বিশাল ক্যাম্পাসের এই স্যান্ডুইচ হাউজটি বেশ নামকরা। স্যান্ডুইচ নিয়ে ফিরে আসতেই সবাই হাজির। গাড়িতে উঠে বসলো তারা। বাবুই পাখির গান যারা শোনেনি কোনোদিন তারা বুঝবে না গাড়ির ভেতরে তাদের কিচির মিচিরগুলো কী অসাধারণ বৈতালিক সঙ্গীত হয়ে ওঠে। তাদের নিজস্ব পছন্দের কিছু মিউজিক আছে। গাড়িতে উঠেই তারা সেগুলো প্লে করে। আজ তারা ভুলে গেছে। আমি নিজেই প্লে করে কিচির মিচির থামিয়ে দিলাম।
- বাবা তাহলে কোথায় যাচ্ছি...
: ললে ফুল দেখতে যাবো, মিলাদ পার্কে..
- ললে ফুল কী?
: টিউলিপ...
- সোহাগি গেয়ে উঠলো “সাহারাতে ফুটলো রে ফুল রঙিন গুলে লা...লা...
একদম ঠিক গানটি ধরেছো। জাতীয় কবি নজরুল ইসলামের সঙ্গীতের কল্যাণে আমরা ‘গুলে লালা’র সঙ্গে মোটামুটি পরিচিত। লালা’র আধুনিক ফার্সি উচ্চারণ হলো ‘ললেহ’। আরবী’তে ‘লাল’ এবং ‘লাআল’ দুটি শব্দ পাওয়া যায়। ‘লাল’ শব্দটি সংস্কৃতিতেও পাওয়া যায় যার রঙ আমাদের সবারই জানা। এই লাল শব্দ থেকে ফুলটির একটা রঙ আমাদের মনোদৃষ্টিতে ভেসে উঠলেও ললেহ ফুল কিন্তু মৌলিক সাতটি রঙেরই লক্ষ্য করা যায়।
: বাবা! ললেহ ফুলের বৈজ্ঞানিক নাম কী?
- টিউলিপা। বৈজ্ঞানিক নামেই সে এখন বিশ্বব্যাপী বেশি পরিচিত।
: টিউলিপ কোন দেশি ফুল?
- বলা হয়ে থাকে যে এই ফুলটি মধ্য এশীয়। তবে আফগানিস্তান, তুরস্ক, ইরান, সিরিয়ার পশ্চিমাঞ্চলের একটা অংশ, আরল হ্রদের উপক‚লীয় অঞ্চল, কাস্পিয়ান হ্রদ ও কৃষ্ণ সাগর তীরবর্তী অঞ্চল, গ্রিস, ইতালি, স্পেন, ফ্রান্স, হল্যান্ড এবং ভ‚মধ্যসাগর উপক‚লীয় অঞ্চলসহ উত্তর আফ্রিকায় এই ফুলের ব্যাপক ব্যবহার ও চাষ হয়ে এসেছে। সুতরাং টিউলিপ বা ললেহ ফুলকে ‘ইউরেশিয়ান’ বললেও সম্ভবত অত্যুক্তি হবে না। বুঝতে পেরেছো?
- জি বাবা!
: তবে এ ফুলের উৎস বা জন্মভ‚মি যেখানেই হোক না কেন ইরান এবং তুরস্কের সংস্কৃতিতে তার রয়েছে সমৃদ্ধ উপস্থিতি। এ দুই দেশের সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অঙ্গ যেন টিউলিপ।
- আচ্ছা বাবা। টিউলিপ তো অনেক রঙের আছে,তাই না?
: হুমম।
জবাব দিতে না দিতেই আবারও প্রশ্ন: কত রকমের টিউলিপ আছে ---
আমি একটু চুপ থেকে বললাম: ইরানে উনিশ প্রকারের টিউলিপ আছে। ফুলের বাহ্যিক রূপ এবং ফোটার সময়ের দিক থেকে একশ পঞ্চান্ন রকমের ললেহ’র সন্ধান দিয়েছেন গবেষকরা। তবে বিশ্বব্যাপী টিউলিপ রপ্তানি ও সরবরাহের দিক থেকে প্রথম পর্যায়ে রয়েছে হল্যান্ড।
রঙ জানতে চেয়েছো না? রঙের দিক থেকে ব্যাপক বৈচিত্র্য রয়েছে টিউলিপ ফুলের। বলা হয়ে থাকে ‘কফি’ বা গাঢ় বাদামি রঙ ছাড়া বাকি সব রঙের টিউলিপই দেখতে পাওয়া যায়। তবে সাদা, হলুদ, কমলা, লাল, গোলাপি, বেগুনী এবং সবুজ এই সাতটি রঙই বেশি। বর্ণচক্রের বাকি রঙগুলো এই সাতটি রঙেরই বৈচিত্র্যমাত্র। রঙের এতো বৈচিত্র্য অন্য কোনো ফুলে আছে বলে জানা নেই।
জবাব শুনে তারা নিজেদের ভেতর শোরগোল তুললো। বিষয় কার কোন রঙ পছন্দ। কেন পছন্দ। পছন্দ নিমেষে পরিবর্তনও হচ্ছে।
ওদের কথা শুনে ললেহ’র প্রতীকী অর্থের কথা মনে পড়ে গেল। ইরানে লাল টিউলিপ ফুলটি শাহাদাতের প্রতীক। টিউলিপের পাপড়িগুলো রক্তের ফোঁটার মতো দেখতে। ইরানের জাতীয় সঙ্গীতের শুরুতে যেই মিউজিক সেখানেও এই ফুলের প্রতীকী ব্যবহার রয়েছে। ইরানের বিখ্যাত কবি আরেফে কাজভিনির লেখা একটি কবিতার পঙ্ক্তি ইসলামী বিপ্লবের সময় সমস্বরে গাওয়া হতো। “আজ খুনে জাওয়াননে ওয়াতান ললেহ দামিদেহ’ মানে জন্মভ‚মির যুবকদের রক্ত থেকে জন্ম নিয়েছে টিউলিপ। এই পঙ্ক্তিটি বিপ্লবের শ্লোগান হিসেবেও ব্যবহৃত হতো তখন।
এর বাইরেও রঙ ভেদে টিউলিপের বিভিন্ন প্রতীকী অর্থ রয়েছে ইরানি সংস্কৃতিতে। সামগ্রিকভাবে ললেহ ফুল হলো দৃঢ় সংকল্পের প্রতীক। হলুদ ললেহ সূর্যের সাথে তুলনীয়। সাধারণত প্রেমিকেরা তাদের প্রেমিকাদের এই হলুদ টিউলিপ উপহার দেয়। হাতে ফুল পেয়ে প্রেমিকারা যখন চোখেমুখে অনাবিল হেসে ওঠে তখন প্রেমিকেরা মনের গহীন থেকে ভালোবাসার শব্দমালা উচ্চারণ করে: তোমার হাসি ওই সূর্যের নির্জলা রোদের মতো। লাল টিউলিপ প্রেমেরও প্রতীক। আর সাদা টিউলিপ সতেজতা এবং সৎ উদ্দেশ্যের প্রতীক।
-বাবা! এক টিউলিপ ফুলের এতো এতো প্রতীকী অর্থ!
: হুমমম!
-আমরা এখন সেই টিউলিপ দেখতে যাচ্ছি..!!
: হুমম।
-বাহ!
উপমা এমনিতেই যে-কোনো বিষয়ের গভীরে যেতে উৎসুক থাকে। ললেহ’র অ্যাতো প্রতীকী ব্যাখ্যা শুনে সে আরও কৌত‚হলী হয়ে উঠলো। আমি তাকে আরও একটা অদ্ভুত তথ্য দিলাম। বললাম:
এত বিচিত্র ললেহ’র মাঝে একটি ললেহ আছে একেবারেই ব্যতিক্রমধর্মী। ললেহ ফুলের পাপড়িগুলো থাকে ঊর্ধ্বমুখী। কিন্তু একটি ললেহ আছে নিম্নমুখি। ফার্সিতে এর নাম হলো ‘ললেহ ভজগুন’ মানে উল্টো ললেহ। এই টিউলিপ নিয়ে কিন্তু একটা রূপকথা আছে।
-বলো বাবা!
উপমা ‘ললেহ ভজগুন’কে নিয়ে প্রচলিত রূপকথা শোনার জন্য বারবার ‘প্লিজ প্লিজ বাবা’ করতে শুরু করে দিলো। ততক্ষণে আমরা ‘মিলাদ পার্কে’ এসে গেছি। গাড়ি পার্ক করে ওয়ান টাইম ইউজ গøাসে চা ঢেলে হাঁটতে শুরু করলাম। বাচ্চারা এই পার্কের পাশ দিয়ে অসংখ্যবার যাওয়া-আসা করেছে। কিন্তু ভেতরে ঢোকেনি কখনো। ঢুকে অবশ্য লাভও হতো না। ললেহ ফুল সব সিজনে দেখা যায় না। ইরানের নওরোজের সঙ্গেই তার সখ্যতা। ইরানের প্রাচীন সাংস্কৃতিক ইতিহাসে নওরোজে এই ফুলের বিচিত্র ব্যবহারের কথা দেখতে পাওয়া যায়। নওরোজ মানেই বসন্তের সূচনা। না গরম না ঠাÐা। এরকম আবহাওয়ায় অবগাহন করার মজাই আলাদা। রিয়্যালিস্টিক কোনো শিল্পীর হাতে কিছু সলিড কালার দিয়ে দেন। আরও দেন মোটা ব্রাশ। এবার শিল্পী যদি বিশাল একটি ক্যানভাসে আঁকাবাঁকা বিচিত্র রঙিন পথের চিত্রকল্প আঁকেন, তাহলে যে চিত্রটি তিনি আঁকবেন সেই চিত্রটিই এখন পুরো টিউলিপ গার্ডেনে দেখতে পাচ্ছি আমি। উপমা, অর্মিতা, সামি তো লাফালাফি চেঁচামেচি শুরু করে দিয়েছে। ফুলকে ধরে আদর করছে। বললাম: ফুল দূর থেকে দ্যাখো! হাত দিও না।
ওদের আদর কিন্তু ভয়ংকর। আদর করে করে রঙীন মাছ মেরে ফেলা আর পাখির বাচ্চার পা ভেঙে ফেলার দায়ে আরও ছোটোবেলা থেকেই দায়ী তারা। তবে সৌভাগ্যের বিষয় হলো একবার তাদেরকে সতর্ক করে দিলেই হলো। সেই কাজটি দ্বিতীয়বার করতে ইচ্ছে করলেও করবে না। রঙিন মাছ মরে যাবার শোক তাদের হৃদয়ে ভয়াবহ কষ্টরেখা এঁকে দিয়ে গেছে। পাখির বাচ্চার করুণ কুজন এখনো তাদের কোমল মনের প্ল্যায়ারে বেজে ওঠে অজান্তেই। সুতরাং একটু সতর্ক করে দিলেই আমি জানি হাতে ধরে আর টিউলিপকে আদর করবে না তারা। করেও নি।
সবুজ ঘাসের বনে বিচিত্র বক্ররেখায় সাজানো টিউলিপ। যেন নিপুণ হাতে ছোপ ছোপ সলিড রঙের ব্রাশের টান। আমি চায়ের কাপে চুমুক দিচ্ছি আর ভাবছি একই ফুলের এতো বৈচিত্র্য! আশ্চর্য! ¯্রষ্টা কত মহান শিল্পী, কত নান্দনিক আমরা তার কতোটুকু জানি! যতই দেখবো ততই জানবো। একটা স্বগতোক্তি মনের ভেতর ধ্বনিত হলো: সারা বিশ্ব যদি ঘুরে ঘুরে দেখতে পেতাম....
উত্তমাংশ বললো: ভাবিদের তো আসার কথা! একটু কল দিয়ে দেখো তো! ভাবি মানে সহকর্মী আমির ভাইয়ের স্ত্রী। আমি সম্বিৎ ফিরে পেলাম। কল দিলাম।
ওপার থেকে জবাব এলো: একটু পরে আসছি...
পুরো পার্ক ঘুরে ঘুরে টিউলিপ দেখলাম, ছবির পর ছবি তুললাম। এতো সুন্দর সুন্দর ফুলের পাশে সখ করে ছবি তোলে সবাই। কিন্তু ছবিতে টিউলিপের আকর্ষণটাই থাকে বেশি। সেজন্য আমি ছবি তোলার ক্ষেত্রে সতর্ক থাকি। সাবজেক্ট কাকে করবো? টিউলিপকে? নাকি টিউলিপ প্রেমিককে? সমস্যা হয়ে যায়। তবু তুললাম। শুধু টিউলিপের। আবার প্রেমিককে সাবজেক্ট করেও।
ছোট সাহেবের চেহারায় বিরক্তির একটা রেখা ভেসে উঠলো। কী হয়েছে বাবা!
: আইম সো হাঙরি ফাদার...
-তাই! চলো! আমরা এক্ষুণি খাবো। সুন্দর কখনো ক্ষুধা মিটায় না। বুঝিয়ে দিলো সামি। সুন্দর ভরপেটেই মর্যাদা পায়।
সবাইকে নিয়ে আমরা নিকুঞ্জের দিকে যাচ্ছি। টিউলিপ বনের ভেতর রঙীন পাথরকুচি দিয়ে সাজানো পথের ক্রসিংয়ে দেখা হয়ে গেল আমার আরেক সহকর্মী আশরাফ রহমানের সঙ্গে। বৌ-বাচ্চাদের নিয়ে এসেছেন। গল্প হলো। রসালাপ হলো। ইতিহাসের উপাদান ছবি তোলা হলো। সবাই বেশ প্রাণবন্ত। আশরাফ রহমানের ছোট ছেলে আয়ানকে জীবন্ত পুতুলের মতো লাগছিল। আমার অর্মিতা ওকে কোলে নিয়ে ঘুরছে। বড় ছেলে আয়মানও খেলে বেড়াচ্ছে আপনমনে। টিউলিপের সাথে ছোটোদেরকেও ফুলের মতোই মনে হলো, জীবন্ত ফুল।
-বাবা! প্লি...জ চলো...
সামি আবারও স্মরণ করিয়ে দিলো ক্ষুধা সৌন্দর্যের মর্ম বোঝে না। সবাইকে বললাম: চলুন! লাঞ্চ করি!
আশরাফ ভাই-ভাবি সমস্বরে জানিয়ে দিলেন তাঁরা খেয়েই এসেছেন। আমরা জৈব জ্বালানির জন্য নিকুঞ্জে বসে গেলাম। ওপেন ইউনিভার্সিটি ক্যাম্পাসের সুস্বাদু স্যান্ডুইচ খাচ্ছি। মোবাইল বেজে উঠলো সহসা।
: হ্যালো...
ভাবির কল। উনি রেডি। বৌ-কে সঙ্গে নিয়ে এক টানে নিয়ে এলাম। জাহরাকে-আমির ভাইয়ের একমাত্র মেয়ে-দেখে উপমারা ভীষণ খুশি হয়ে গেল। তাদের আনন্দের বার্তা চোখে মুখে বিজলির মতো প্রকাশ পাচ্ছিল। হালকা বৃষ্টির ফোঁটা নিকুঞ্জের প্লাস্টিক গøাসের চালায় ঝিরঝির শব্দের ব্যঞ্জনা সৃষ্টি করলো। রবীন্দ্রসংগীত আনমনেই বেজে ওঠে কণ্ঠে:
আজি ঝরো ঝরো মুখর বাদর দিনে
জানি নে, জানি নে
কিছুতেই কেন যে মন লাগে না ।।
এই চঞ্চল সজল পবন-বেগে
উদ্ভ্রান্ত মেঘে মন চায়
মন চায় ঐ বলাকার পথখানি নিতে চিনে ।।
মেঘমল্লারে সারা দিনমান
বাজে ঝরনার গান ।
মন হারাবার আজি বেলা
পথ ভুলিবার খেলা
মন চায়... মন চায় ...
হৃদয় জড়াতে কারো চির-ঋণে
সংগীত অনুক‚ল প্রাকৃতিক পরিবেশ-উন্মুখ। যথাযথ পরিবেশে স্বয়ংক্রিয় হয়ে ওঠে। কবিতাও তাই। বিদ্যাপতিও তাই বেরিয়ে এলো ছায়াচিত্রের মতো:
এ সখি হামারি দুখের নাহি ওর
ই ভরা বাদর মাহ ভাদর শূন্য মন্দির মোর...
-বাবা ! থামবে প্লি....জ
: কেন রে মা!
-ভাল্লাগে না..
: তুমি তো অর্থ বোঝো না, তাই ভালো লাগে না.. এটা কিন্তু বিখ্যাত কবি বিদ্যাপতির কবিতা। বিদ্যাপতি আমাদের প্রাচীন কবিদের অন্যতম...
-আবার...!
ঠিক আছে বাবা! থামলাম।
এখনকার বাচ্চারা এসব পছন্দ করে না। রবীন্দ্র সংগীত, আবৃত্তি ইত্যাদি। এজন্য কি আমরা দায়ী? নাকি প্রযুক্তি? নাকি প্রবাস...?
মৌনতা ভেঙে দিলেন ভাবি। বিশাল সাইজের সমুচা একটা হাতে দিয়ে বললেন: এইমাত্র বানিয়েছি। গরম গরম খান, ভালো লাগবে।
আপ্যায়নে, পরিবেশনায় আন্তরিকতার অভাব নেই। কিন্তু অভাব ছিল ক্ষুধার। একটু আগেই স্যান্ডুইচ খেয়েছি। তবু হাত বাড়িয়ে নিলাম। মুখে দিতেই ক্ষুধা বেড়ে গেল। উপরে সমুচার মতো ভেতরে চিকেন। কী বলা যায়? চিকেন সমুচা?
-ভাবি! এক কথায় অসাধারণ! ভাবির হাত নড়েচড়ে উঠলো। ব্যাগের ভেতর থেকে কাঁচের একটা বাটি বের করে ঢাকনা মেলে বললেন: এটাও মজার! খান!
: কী এটা..?
-খেজুর গুড়ের হালুয়া...
: অ্যাতো হালুয়া কি এখন খাওয়া যাবে ভাবি!
-ভাবি হাসতে হাসতে কাঁচের বাটিতে ঢাকনা লাগিয়ে বললেন: এই যে, ব্যাগের ভেতর দিয়ে দিলাম। বাসায় গিয়ে খাবেন।
চায়ে চুমুক দিতেই আশরাফ ভাই তার ফুলপাখিদের নিয়ে নিকুঞ্জে এসে গেছেন।
দুই ছেলে আশরাফ রহমানের। দুজনই দেখতে ফুলের মতো সুন্দর,নিষ্পাপ-আয়মান আর আয়ান। আমার তিন পাপড়ি মিলে এখন পঞ্চ পাপড়ির ফুল হয়ে তারা পার্কের শোভা বর্ধন করছে। আমির ভাইয়ের মেয়ে জাহরা বৃন্তের মতো ধরে রেখেছে তাদের। সে সবার মুরব্বি এখন। কেউ গাছে উঠছে, কেউ পার্কে দৌড়ে বেড়াচ্ছে। আমরা নিকুঞ্জে বসে খোশগল্পের সঙ্গে চা খাচ্ছিলাম। হঠাৎ উপমা দৌড়ে এসে বললো: বাবা! রূপকথাটি কিন্তু বলোনি।
-ও তাই!
: এখন বলো!
উপমার এ এক স্বভাব। আমি অবশ্য এই কৌত‚হলি স্বভাব খুব পছন্দ করি। সে কারণে ভীষণ সতর্কও থাকি। ও বাবার কথাকে সাংঘাতিক গুরুত্ব দেয়। আমিও তার সম্মান রাখার চেষ্টা করি। কোনোরকম গোঁজামিল-টিল দেওয়ার চেষ্টা কখনো করি না। যাই হোক, উপমা ততক্ষণে সবাইকে ডেকে এনে জড়ো করেছে। রূপকথা শোনার জন্য।
আমি শুরু করলাম: আচ্ছা তোমরা কি ফেরদৌসির নাম শুনেছো!
হ্যাঁ শুনেছি...! সামি কিচ্ছু বললো না..
: সামি! ফেরদৌসি হলো ইরানের একজন বড় কবি। সেই কবি একটা বড় কাব্য লিখেছেন। মহাকাব্য। নাম হলো শাহনামা। আমরা যেই রূপকথাটি শুনবো এখন, সেই রূপকথাটি এসেছে ফেরদৌসির মহাকাব্য শাহনামাতেও। রূপকথাটি হলো: গার্সিভাজ নামের এক লোক ছিল তুরানের সেনা কমান্ডার।
-তুরান কী? (সবাই একসঙ্গে)
: তুরান হলো এশিয়া মাইনর!
-এশিয়া মাইনর কী?
: এই সেরেছে! বাচ্চারা যেভাবে প্রশ্ন শুরু করেছে, কখোন যে ধরা খেয়ে যাই...
-বলো...
: হ্যাঁ বলছি... এশিয়া মাইনর, না? হুমম এশিয়া মাইনর হলো একটা ভ‚খÐের নাম। মাইনর মানে ছোট। তাহলে এশিয়া মাইনর হলো স্মল এশিয়া। স্মল এশিয়ার আরেক নাম ‘আনাতোলিয়া’। আধুনিক তুর্কিতে বলা হয় ‘আনাদোলু'। বর্তমানে এই আনাতোলিয়া বৃহত্তর তুরস্কের অংশ। তাহলে আমরা এখন বলতে পারি তুরান হচ্ছে তুরস্ক। ওকে...!
-হ্যাঁ ঠিক আছে। গার্সিভাজের কথা বলো!
: হ্যাঁ, গার্সিভাজ। সে ছিল ফাশাঙ্গের সন্তান। আফ্রসিয়াব ও আগ্রিরাসের ভাই ছিল সে।
কেইকাউস এবং আফ্রসিয়াবের মধ্যে একবার যুদ্ধ বেধেছিল। তখন আফ্রসিয়ব যুদ্ধের এক পর্যায়ে সিয়ভাশের সঙ্গে সমঝোতার প্রস্তাব দেয়।
-সিয়ভাশ কে বাবা..!
: হুমম বলছি। সিয়'ভাশ হলো শাহনামা কাব্যের একটি আলোচিত এবং জনপ্রিয় বীর চরিত্র। ইরানের এক সম্রাট ছিল কাভুস নামে। সিয়ভাশ ছিল সেই কাভুসের সন্তান। জন্মের পরই তাকে রুস্তম এর কাছে পাঠানো হয়। ওরা হা করার আগেই বলে দিলাম রুস্তম হলো এক মহা পালোয়ান। রুস্তমের তত্ত¡াবধানে সাত বছর থেকে যুদ্ধবিদ্যাসহ শিকারে দক্ষতা অর্জন করে সিয়ভাশ। সে বীরত্বপূর্ণ নানা গুণও অর্জন করে। যে-কোনো মহাকাব্যে এ ধরনের বীরত্বপূর্ণ চরিত্র থাকে। তোমরা বড় হলে ইলিয়াড, ওডেসি, ইনিড,প্যারাডাইস লস্ট ইত্যাদি পড়লে আরও জানতে পারবে। তো বলছিলাম গার্সিভাজকে পাঠানো হয় সিয়ভাশের সঙ্গে সমঝোতার প্রস্তাব নিয়ে। প্রস্তাব নিয়ে যাওয়ার সময় গার্সিভাজের সঙ্গে দেওয়া হয়েছিল অসংখ্য ঘোড়া, মূল্যবান সব উপহার সামগ্রি এবং দুই শ জন যুদ্ধ উপদেষ্টা। তারা গিয়ে সিয়ভাশকে সমঝোতার প্রস্তাব দেয়। প্রস্তাব পাবার পর সিয়ভাশ এক সপ্তা ধরে রুস্তমের সঙ্গে শলা পরামর্শ করে শেষ পর্যন্ত সমঝোতায় রাজি হয়। কিন্তু সিয়ভাশের ব্যাপারে প্রেমঘটিত কারণে ঈর্ষান্বিত ছিল গার্সিভাজ।
-একটু খুলে বলো বাবা!
: না, এখন বলা যাবে না। অনেক বড় কাহিনী। আমরা তো বেড়াতে এসেছি। ঘুরে বেড়াবো। সংক্ষেপে কাহিনীটা বলছি। শোনো। পরে একসময় আমরা শুনবো।
-ওকে বাবা!
: আচ্ছা! গার্সিভাজ তার ভাই আফ্রাসিয়াবকে ইরানের তরুণ রাজকুমার সিয়ভাশের বিরুদ্ধে ক্ষেপিয়ে তুলতে সমর্থ হয়। এক পর্যায়ে গার্সিভাজ, নিষ্পাপ সিয়ভাশকে কাপুরুষের মতো নির্দয়ভাবে খুন করে।
-কীভাবে?
: ছুরি দিয়ে মাথা কেটে ফেলে...
-ইসসসস....
: তো জনগণের বদ্ধমূল বিশ্বাস হলো-গার্সিভাজ যখন নিষ্পাপ সিয়ভাশের মস্তক কেটে ফেললো নিজের ছুরি দিয়ে, তখন এই ভাজগুন ললেহ ফুলটিই ছিল সেই দুর্ঘটনার একমাত্র সাক্ষী। নীরব সাক্ষী। এই মর্মান্তিক ঘটনা সহ্য করতে না পেরে ভাজগুন দুঃখে শোকে ভেঙে পড়লো। তার ওপর মারাত্মক প্রভাব পড়লো দুঃখজনক হত্যাকাÐটির। তার চেহারা লাল হয়ে গেল এবং মাথা নিচু করে সিয়ভাশের জন্য কান্নাকাটি করতে করতে সেই যে তার ঘাড় বেঁকে নীচে নেমে গেল, আর উপরে ওঠেনি কোনোদিন।
-তাই.. বলো কী...
: হ্যাঁ! এটা তো রূপকথা! বলেছি না! তবে ইরানের পভেহ এবং উরামানাত এলাকায় এই ফুলকে এখনও ‘সিয়ভাশের অশ্রæ ফুল’ বলে অভিহিত করা হয়। ইরানের কুর্দিস্তানের অধিবাসীরা মনে করে এই ফুল যে ছিঁড়বে আল্লাহর রহমত ও বরকতের দরোজা তার জন্য বন্ধ হয়ে যাবে। এ কারণে এই ভাজগুন ললেহ’কে ‘নন বোর’ও বলে তারা। ফার্সিতে ‘নন’ মানে হলো রুটি বা খাদ্য আর “বোর” মানে হলো কাটা। তাহলে ‘নন-বোর’ বলতে কী বুঝালো?
সবাই চুপ! আমিই বলে দিলাম: যে ফুলের কারণে রিজিক (খাদ্য) বন্ধ হয়ে যায়।
-এক্সেলেন্ট বাবা! রূপকথাটি খুব সুন্দর। সবাই একযোগে বলে উঠলো: ইয়ে....স..
আমি মোবাইল ঘড়িতে সময় দেখলাম। বেশি বাকি নেই সন্ধ্যা নেমে আসার। সন্ধ্যাটা যদিও অনেক সুন্দর। রঙিন আলোর ঝলকানিতে ঠাসা, তবু উঠে যাবার তাড়াটা ঠাÐার কারণে। যতই বিকেলটা সন্ধ্যার দিকে গড়ায় ততই ঠাÐাটা বেশি অনুভ‚ত হয়। সূর্যের আলোটা আরও বেশি কাজে লাগানোর চিন্তায় উঠে পড়লাম আমরা। নিকুঞ্জের পুঞ্জিভূত আনন্দ আর রূপকথা মাথায় নিয়ে সবাই চলছি টিউলিপ বাগানের দিকে। জাহরা আর তার মাও এই বাগানে এই প্রথম এসেছে। তাঁদের ঘরের পাশেই কিন্তু। যদিও অনেক দূরের বহু পার্কে বেড়াতে গেছেন ঠিকই। রবীজী এমনিতে বলে যাননি:
বহু দিন ধ’রে বহু ক্রোশ দূরে
বহু ব্যয় করি বহু দেশ ঘুরে
দেখিতে গিয়েছি পর্বতমালা,
দেখিতে গিয়েছি সিন্ধু।
দেখা হয় নাই চক্ষু মেলিয়া
ঘর হতে শুধু দুই পা ফেলিয়া
একটি ধানের শিষের উপরে
একটি শিশিরবিন্দু....!
টিউলিপ বাগান পেরিয়ে আমরা যাবো পাশের ‘দনেশ’ পার্কে। এরকমই সিদ্ধান্ত হলো। ফার্সি “দনেশ” অর্থ হলো জ্ঞান বা শিক্ষা। সেই জ্ঞান কিংবা শিক্ষাঙ্গনে বাচ্চারা খেলবে। শুনেই খুশিতে চীৎকার করে উঠলো তারা। ইরানের পার্কগুলোতে বাচ্চাদের খেলার আয়োজন থাকে। ফ্রি। ভাবতেই কেমন অবাক লাগে, তাই না? ইরানে আরও একটি বিষয় খুবই বিস্ময়ের। সেটা হলো ফ্রি ড্রিঙ্কিং ওয়াটার। পার্কে তো বটেই। রাস্তাঘাটে, জনসমাগম যেখানে হয়, সেসব জায়গায় ফ্রি ঠাÐা পানির ব্যবস্থা থাকে। আমরা অবশ্য পানি নিয়েই এসেছিলাম। উপমা কখনোই পানির বোতল সঙ্গে নিতে ভোলে না। আজও ভোলেনি। আমরা যাচ্ছি টিউলিপ বাগানের ভেতর দিয়ে। জাহরারা ব্যাপক আনন্দিত, উৎফুল্ল, প্রাণবন্ত। হৈ চৈ, হাসি উল্লাসে ঝরে পড়ছে বাচ্চাদের মনের ভেতরে জমে থাকা সকল বিষন্নতার উড়ো বালির স্তর। ছবির পর ছবি তুলে পার্কের ভেতরে ঢুকতেই নজরে পড়লো ফুটফুটে একটি মেয়ে কাঁদছে। উপমা, অর্মিতা, সামি, জাহরা সবাই একসঙ্গে দৌড়ে এসে জানালো বাচ্চাটি কাঁদছে বাবা! জিজ্ঞেস করলাম: কাঁদে কেন?
-ও হারিয়ে গেছে।
: মানে?
-মানে ও তার মাকে খুঁজে পাচ্ছে না।
মাই গুডনেস। দৌড়ে ছুটে গেলাম শিশুটির কাছে। ফুটফুটে, গোলাপি শিশুটির দুই গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে পানি। বেদনার হিক্কা উঠছে থেকে থেকে।
শিশুরা এমনিতেই সুন্দর। তাদের হাসি কান্না, মান অভিমান, দুষ্টুমি, চিৎকার-চেঁচামেচি সবকিছুই সুন্দর। সেই সুন্দর অবশ্য সবাই দেখে না। চোখ থাকতে হয় দেখার। এই শিশুটির কান্না দেখে আমার ভীষণ ভালো লাগছিল। কান্নার একটা আর্ট আছে। ঠোঁট গাল আঁকাবাঁকা করে কান্নাকাটি এক ধরনের আর্ট। কৌত‚হলি দৃষ্টি এদিক ওদিক মেলে ধরে কান্না করা এক ধরনের আর্ট। আবার কিছু কিছু কান্না আছে বেশ অভিজাত। কোনোরকম হিক্কা ওঠানো নেই, অভিযোগ অনুযোগ নেই, কপোলে লালিমা মেখে নীরবে অশ্রæ ঝরানো কান্না-এই কান্না খুবই অভিজাত। সাধারণত শিশুদের মাঝে এই কান্নার প্রবণতা দুর্লভ। তবে এই শিশুটির কান্না অনেকটাই সেরকম অভিজাত ছিল। আমার সঙ্গে বাচ্চারাও এসে হাজির। আপন সন্তানের মতো আদর মাখা হাতের বেষ্টনিতে নিয়ে চোখের দিকে তাকালাম। জিজ্ঞেস করলাম: ফমিলেতুন চিয়ে। মানে তোমার ফ্যামিলি নেম কী।
:কিমিয়া...
-কাঁদছো কেন?
: আমি হারিয়ে গেছি।
-কীভাবে হারিয়ে গেছো..
: আমি আমার ভাইয়ের সঙ্গে বল নিয়ে খেলছিলাম। বলটা এদিকে চলে এসেছে। আমি বল খুঁজতে খুঁজতে এখানে এসেছি। এখন বলও পাচ্ছি না, আমার ভাইয়া, মামনি, দাদিকেও পাচ্ছি না...অ্যাঁ.....অ্যাঁ..
এবার কিমিয়া তার আভিজাত্য ভেদ করে সত্যিই কেঁদে দিলো...। আমি তাকে সান্ত¡না দিয়ে বললাম:
-না, হারাও নি তুমি। আমি জানি তোমার মা, দাদি, ভাইয়া কোথায়। এই যে তোমার কয়েকটা ফ্রেন্ড! এদের সঙ্গে যাও। ওরা তোমাকে তোমার মায়ের কাছে পৌঁছে দেবে। ঠিক আছে?
মাথা নেড়ে কিমিয়া সম্মতি জানালো। উপমা পার্কে ঢুকতেই কিমিয়াকে খেলতে দেখেছিল। সে বললো: বাবা! আমি মনে হয় ওর মা আর দাদিকে চিনবো। এই বলেই অর্মিতা আর জাহরাকে সঙ্গে নিয়ে উপমা দৌড়ে চলে গেল। আমি কিমিয়া আর সামি ধীরে ধীরে এগুচ্ছি অজানার দিকে। কিমিয়ার শিশুমন সান্ত¡না পেয়ে নিশ্চিন্ত হয়ে গেল। আমি ওর দিকে তাকালাম। গোলাপের কুঁড়ি যেন। স্বর্ণালি চুলগুলো এলোমেলো হয়ে ঝুলছে। মুখমÐল জুড়ে বিষন্নতার মেঘ। একটু বৃষ্টি একটু রোদ দরকার। দাদি-মা’কে পেলেই তবে রঙধনু উঠবে আমি নিশ্চিত।
অনুসন্ধানী চোখ আমার দু’জন রমনীর দিকে। একজন মা, একজন দাদি। অপেক্ষায় আছি কোনো একজন মহিলা দৌড়ে এসে কিমিয়াকে জড়িয়ে ধরে বলবে: কোথায় হারিয়ে গেলি মা। আমি তোকে হন্যে হয়ে খুঁজছি। কিন্তু না। কাউকেই দৌড়ে আসতে দেখছি না তো! শিশুমন কতো সহজ সরল। আমি একটু আদর দিয়ে কথা বললাম আর অমনি কিমিয়া তার পরিপূর্ণ বিশ্বাস নিয়ে আমার সঙ্গে চলে এলো। কোনো দুষ্টু লোক যদি আমার মতো শিশুটিকে হরণ করে নিয়ে যেত! ভাবতেও গা শিউরে ওঠে। ইরানে অবশ্য সেরকম কোনো ঘটনা ঘটতে দেখিনি। তবে আজকাল পার্কে গেলে বুড়িরা, অভিভাবকরা সতর্ক থাকতে বলেন। শিশুদের নিয়ে বিচিত্র বাণিজ্য যারা করে ‘উহারা কাহার জন্ম নির্ণয় ন জানি”। কতো পাষাণ হৃদয় হলে নিষ্পাপ একটি শিশুর প্রতি পাশবিকতা দেখাতে পারে, ভেবে কুল পাচ্ছি না।
-বাবা! আমি ওর ভাইয়াকে দেখেছি। ওকে দেখলেই আমি চিনতে পারবো।
সামি হঠাৎ ভাবনার মেঘে ফুঁ দিয়ে দিলো। শিশুরা শিশুদের দিকে নজর দেবে সেটাই স্বাভাবিক। কোন কোন শিশু এই পার্কে খেলা করেছে, কী নিয়ে খেলেছে, কারা কারা ছিল তাদের দৃষ্টিতে পড়ে যাওয়াটা অযৌক্তিক নয়। আমি সামি’র কথায় কিছুটা আশ্বস্ত হলাম। অবশ্য নিরাশ আমি কখনোই হই না। আল্লাহর এ এক অপার দান আমার ওপর। নজরুলের মতো আমি ‘জাহান্নামের আগুনে বসিয়া হাসি পুষ্পের হাসি’। হতাশ হয়ে কী লাভ। হা হুতাশ, উত্তেজনা দেখিয়েও কোনো লাভ নেই। বিপদে মাথা ঠাÐা রাখাই সঙ্গত। টিউলিপ বাগানের রঙিন সৌন্দর্যের ভেতর মুহূর্তের জন্য ভাবনার একটা অদৃশ্য কুয়াশা যেন চাদর বিছিয়ে দিয়ে গেল। সহসাই সেই চাদর হ্যাঁচকা টানে ছুঁড়ে ফেলে দিয়ে তিনটি হাসিমুখ “ইউরেকা”র আনন্দবার্তার প্ল্যাকার্ড নিয়ে দৌড়ে এলো। জাহরা, উপমা, অর্মিতা হাঁফাচ্ছে। এক বুড়ি তাদের সঙ্গে। মেলাতে পারলাম না। সত্তরোর্ধ্ব বুড়ি আর এই শিশু। অপেক্ষা করলাম। তিনজনই কে কার আগে বলবে মতো কোরাস তুললো: কিমিয়ার... দাদিকে...হ পেয়েছি...হ”। প্রতিটি শব্দের শেষে হাঁপানোর হ যুক্ত হলো তাদের কণ্ঠে।
হাঁফাতে হাঁফাতেই বলছে ওরা। বুড়িকে সালাম দিলাম। কিমিয়ার দিকে তাকালাম। ভাবসাব দেখে মনে হলো চিনেছে বুড়িকে। তবে খুব একটা আগ্রহ দেখালো না। জিজ্ঞেস করলাম: মি শেনোচি... মানে চেনো?
মাথা নেড়ে হাঁ-সূচক জবাব দিলো কিমিয়া।
-কে?
: মদার বুজুর্গামে মানে আমার দাদি...
কিমিয়া আগ্রহ না দেখালেও দাদি কিন্তু কাছে টেনে নিতে চাইলো তাকে। আমি অনাগ্রহ দেখে কিমিয়াকে পুরোপুরি ছাড়লাম না। এক হাত আমার হাতে তার। অপর হাত দাদির হাতে। ফ্যালফ্যাল করে কিমিয়া তাকিয়ে আছে আমার দিকে। যেন সে দাদির চেয়ে আমাকেই বেশি নিরাপদ মনে করছে। হায় রে পৃথিবী! হায় রে জীবন! হায় রে মায়া! হৃদয় কী এক অদ্ভুত জিনিস। ছোটবেলা থেকে যাদের কাছে থেকে বড় হয়েছে কিমিয়া, আধা ঘণ্টার আবেগি মায়ায় সেসব ভুলে গেছে সে। শাসন আর আদরের পরিণতি এরকমই হয়। কিমিয়াকে কাছে টেনে নিয়ে আদর করে দিয়ে বললাম:
-বলেছিলাম না! আমি জানি তোমার মা, দাদি, ভাইয়া কোথায়! তোমার মাও এক্ষুণি আসবেন।
বলতে না বলতেই মধ্যবয়সি এক নারী এসে ‘কিমিয়াজুন’ বলে কোলে জড়িয়ে নিলো শিশুটিকে। তার সঙ্গে এক বাচ্চাও আছে-কিমিয়ার ভাই। হারিয়ে যাওয়া সন্তানকে খুঁজে পাবার আনন্দ কীরকম, তা ক্যামেরাবন্দি করার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু কিমিয়ার মা সেই সুযোগ দিলো না। অপরাধবোধ কাজ করছে তার মাঝে। লজ্জা তো আছেই। ওই দায়িত্বকাÐহীনার চেহারা দেখাতে বিবেক সাড়া দিচ্ছিল না। ইরানি মহিলারা হিজাবের অংশ হিসেবে একটা চাদর পরে। ওই চাদর দিয়ে মুখ ভালোভাবে ঢেকে অস্ফুট কণ্ঠে কিমিয়ার মা বললেন:
-খেইলি মামনুন (ধন্যবাদ)। লুৎফ কারদি হাজি অগা! (আপনি অনেক দয়া করলেন) খেইলি জাহমাত কেশিদি (অনেক কষ্ট করেছেন)। মান এনকাদ পারিশুন... (আমি এতে বেশি পেরেশান...) বলে আর বলতে পারলো না।
দেখা না গেলেও বুঝলাম উষ্ণ অশ্রæর ক’ফোঁটা গড়িয়ে পড়ছে। আমি শুধু বললাম:
- না, না, ভাজিফেয়ে মান বুদ... (এটা আমার দায়িত্ব ছিল)
আমি কিমিয়ার দিকে তাকালাম। কিমিয়ার মুখে অনাবিল হাসি। ওই যে বলেছিলাম রঙধনু উঠবে। কিমিয়ার মুখের হাসিতে ওঠা রঙধনুই যে ছড়িয়ে রয়েছে পুরো টিউলিপ বাগানজুড়ে। জাহরা, উপমা, অর্মিতা, সামি কিমিয়াকে সঙ্গে নিয়ে ছবি তুললো। কিমিয়া চলে আসতে চায় ওদের সঙ্গে। শিশুমন কোমলে জড়িয়ে যায়। আমি অনুসন্ধানী চোখে দেখছি তাদের দৃষ্টি বিনিময়, বাক বিনিময়। হাত তুলে নাড়ছে বিদায়ের প্রতীক। দু’পক্ষই হাত নাড়তে নাড়তে বললো: খোদা হাফেজ!
বাচ্চারা ভীষণ উৎফুল্ল কিমিয়াকে তার মায়ের কাছে ফিরিয়ে দিতে পেরে। কে কী করেছে, কে আগে কাকে দেখেছে, কে না হলে খুঁজেই পেত না মা-দাদীকে, পার্কজুড়ে এখন সেই বীরত্বের গল্প তাদের মুখে। শ্রোতা শুধু আমি। গভীর ধৈর্যের সঙ্গে কলকাকলিময় সেই গল্প হজম করতে করতে দনেশ পার্কের উদ্দেশে রওনা হলাম আমরা। আশরাফ ভাইয়ের আয়ান টিউলিপ গার্ডেনের সবুজ গালিচায় খেলছে। বাবা বল দিচ্ছে তার হাতে। সে বল ছুঁড়ে মারছে দূরে। বল ছুঁড়েই আনন্দে আত্মহারা হয়ে যাচ্ছে আয়ান। শিশুদের খেলার বিচিত্র যাতনা যে কী করে সহ্য করতে হয়-পিতা-মাতাই তা শুধু জানে। বলাবাহুল্য! সেই যাতনায় আনন্দই বেশি।
খেলা এবং বলসহ আয়ানকে কোলে নিয়ে হাঁটতে শুরু করেছেন আশরাফ ভাই। পেছনে কিচির মিচির মিছিল। পড়ন্ত বিকেলের সন্ধ্যামুখি সময়গুলো বড় বেশি হৃদয়গ্রাহ্য। টিউলিপের বিচিত্র রঙ মনে ঢেলে নিয়ে ‘জ্ঞান’ পার্কের দিকে যেতে যেতে সত্যজিত রায়কে মনে পড়ে গেল: আহা কি আনন্দ আকাশে বাতাসে। শাখে শাখে পাখি ডাকে কত শোভা চারি পাশে। আজকে মোদের বড়ই সুখের দিন। আজি ঘরের বাঁধন ছেড়ে মোরা হয়েছি স্বাধীন...
লেখক: কবি ও সাংবাদিক