১৮ নভেম্বর, ২০২৩ ১৬:৪৫ পি এম
[আশির দশকের প্রধান কবি মোশাররফ হোসেন খান। তাঁর সাহিত্যকর্মে আমাদের বাংলা কবিতাসহ সাহিত্যের জমিনটি উর্বর হয়ে উঠেছে। তাঁর পদচারণা কেবলমাত্র সাহিত্যকেন্দ্রিক। আমগ্ন সাহিত্যপ্রেমিক। অসম্ভব মেধাবী ও মৌলিক কবি হিসাবে তিনি আমাদের সাহিত্যকে উজ্জীবিত করে তুলেছেন। তিনি এখনো লেখা-লেখি, সম্পাদনাসহ সাহিত্যের নানাবিধ কাজে ব্যস্ত সময় অতিবাহিত করেন। এই প্রখ্যাত কবির ৫৮তম জন্মদিন ২৪ আগস্ট, ২০১৫। এ উপলক্ষে কবির নিম্নোক্ত সাক্ষাৎকারটি গ্রহণ করেছিলেন-ইয়াসিন মাহমুদ।]
আগামী ২৪ আগস্ট আপনার ৫৮তম জন্মদিন। প্রথমেই আপনাকে জানাই জন্মদিনের শুভেচ্ছা। জীবনের এই পর্যায়ে এসে আপনার উপলব্ধি কি?
মোশাররফ হোসেন খান : আমার ভক্ত, পাঠক ও দেশবাসীর প্রতি আমারও শুভেচ্ছা রইল। সকলের দোয়া কামনা করছি। জীবনের এই পর্যায়ে এসে জীবন, মানুষ, দেশ-জাতি ও বিশ্বব্যাপী আমি যে উপলব্ধি সঞ্চয় করেছি, তার মূল্য কম নয়। অন্তত মানুষ ও সমাজ সম্পর্কে আমার একটা স্বচ্ছ ধারণা তৈরি হয়েছে। যা আমার সাহিত্য জীবনে অনেক কাজে আসবে।
আপনার বন্ধু সহকর্মী ঐতিহ্যবাদী কবি মতিউর রহমান মল্লিক কয়েক বছর আগে এই আগস্ট মাসেরই ১২ তারিখে দুনিয়া থেকে চলে গেছেন। আপনার এই জন্মদিনে কি আপনি তাঁর শূন্যতা অনুভব করছেন?
মোশাররফ হোসেন খান : কেন করবো না! অবশ্যই মল্লিক ভাইয়ের শূন্যতা শুধু এই একটি দিনে নয়, বছরের প্রতিটি দিনই অনুভব করি। কারণ মল্লিক ভাই ছিলেন আমার অত্যন্ত কাছের এবং ঘনিষ্ঠ বন্ধু । তাঁকে আমার পরিবারের একজন সদস্য হিসাবেও মনে করতাম। আমাদের জীবনের বহু সময়, বহু বছর একই সাথে কেটেছে। ঐতিহ্যিক ধারার সাহিত্যভিত রচনার আন্দোলনে আমরা সকল সময় আমগ্ন ডুবে থাকতাম। রাত-দিন একই সাথে কাজ করতাম। সবচেয়ে মজার বিষয় হলো, আশির দশকের আমি এবং মল্লিক ভাই-দু'জনই ছিলাম সম্পূর্ণ অবৈষয়িক চিন্তার মানুষ। অর্থবিত্ত এবং সংসার নিয়ে কখনো ভাবিনি আমরা ছিলাম আমগ্ন সাহিত্য-পাগল মানুষ। তাঁর সাথে আমার কত যে স্মৃতি, কত যে ঘটনা, কত যে ইতিহাসের টুকরো বুদ্বুদ রয়ে গেছে তার কোনো হিসাব নেই । সর্বক্ষণ সেসব স্মৃতি আমাকে তাড়িয়ে নিয়ে বেড়ায় । আমি অস্থির হয়ে উঠি। কখনো কম্পিত বা শিহরিত হই। তাঁর মতো বন্ধু আর কখনো কাউকে পাইনি। আল্লাহপাক তাঁকে জান্নাত নসিব করুন।
একসময় জাতীয় দৈনিক, বিভিন্ন সাময়িকীতে আপনার লেখা নিয়মিত দেখতাম। এখনও সরব উপস্থিতি আছে, কিন্তু আগের মতো নয়, এর কারণ কি?
মোশাররফ হোসেন খান : হ্যাঁ, আশি এবং নব্বই দশকে আমার লেখা বাংলাদেশ, ভারতসহ বিভিন্ন দেশে প্রচুর প্রকাশিত হয়েছে। লেখার অনুবাদও হয়েছে। দেশের সকল বড় বড় সাহিত্য পত্রিকা ও সাময়িকীতে সমানে লিখেছি। কারণ তখনও সাহিত্যে রাজনীতির কালো আবর্জনা প্রবেশ করেনি। নব্বইয়ের পর যখন বাংলাদেশের প্রতিটি পত্র-পত্রিকা রাজনীতি নির্ভর হয়ে পড়লো তখনই শুরু হলো কে কোন দলের লেখক, কবি বাছাই করা। এক ধরনের উঠতি বয়সের চ্যাংড়া ছেলেদের হাতে সাহিত্য পাতার দখলদারি চলে গেল। ফলে এক দিকে তালিকার অত্যাচার আর অন্য দিকে অসাহিত্যিক তথাকথিত সাহিত্য সম্পাদকদের অনৈতিক দৌরাত্মের কারণে লেখা-লেখি প্রকাশের ক্ষেত্রে সতর্ক হতে হয়েছে। এটা আত্মমর্যাদা রক্ষার জন্যও বটে। তবে হয়তো অনেকের স্মরণ আছে যে, বিশেষ করে বাংলাদেশে আশির দশকের কবিদের মধ্যে সবচেয়ে বেশি পত্র-পত্রিকায় আমার লেখা প্রকাশিত হয়েছে।
আপনার সম্পাদনায় প্রকাশিত ‘নতুন কলম'-এর পাঠকরা আবার কবে তাদের এই প্রিয় মাসিক সাহিত্য পত্রিকাটি হাতে পাবেন?
মোশাররফ হোসেন খান : মাসিক ‘নতুন কলম' নিয়ে এখনও আমার স্বপ্ন প্রচুর। যেহেতু বাংলাদেশে ঐতিহ্যিক ধারার আর কোনো মাসিক সাহিত্য পত্রিকা নেই, সেই কারণে ‘নতুন কলমের' প্রয়োজনীয়তা অনেক বেশি কিন্তু কোনো পৃষ্ঠপোষক কিংবা প্রতিষ্ঠান ছাড়া এধরনের একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশ করা সম্ভব নয়। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, সে ধরনের কাউকে আজ পর্যন্ত পাইনি। তবে আমি হতাশ নই। আল্লাহর সাহায্য কামনা করে যাচ্ছি। তিনি সাহায্য করলেই আবারও পাঠকের হাতে ইনশাআল্লাহ ‘নতুন কলম' তুলে দিতে পারবো। এব্যাপারে সকলের সহযোগিতাও কামনা করছি।
আপনাকে আগের মতো সাহিত্য আড্ডাগুলোতে দেখি না কেন? আপনি কি স্বেচ্ছানির্বাসনে আছেন? এর কারণ কি কোন অভিমান না অন্য কিছু?
মোশাররফ হোসেন খান : একটা সময় ছিল যখন সকল সময় সাহিত্য আন্দোলন নিয়েই সময় পার করেছি। আমিতো সাহিত্য ছাড়া অন্য কিছু বুঝি না! জানিও না। তখন মল্লিক ভাইসহ যে সকল বন্ধুদের সাথে পথ পাড়ি দিয়েছি, তাঁরা এখন স্তিমিত । আর এখন সাহিত্য সভা কিংবা আড্ডা কোথায় হয় সেটাও আমার অজানা থাকে। নবীন বয়সের যারা তাদের মধ্যেও তো সে ধরনের সরব কিছু লক্ষ্য করি না। হতে পারে আজকে যারা দু'একটা সাহিত্য সভা কিংবা আড্ডার আয়োজন করে তারা হয়তো আমার প্রয়োজনবোধ করে না। কারণ সে ধরনের প্রাণের ডাক কোথাও শুনতে পাই না। ফলে অভিমান বলেন আর স্বেচ্ছানির্বাসন বলেন-যেটাই বলুন না কেন, সেটাই হতে পারে। তবে শ্রদ্ধাপূর্ণ আন্তরিক আহবান আমি কখনো প্রত্যাখ্যান করি না ।
আসছে বই মেলায় আপনার প্রিয় পাঠকদেরকে আপনি উপহার দিবেন, কবিতা, উপন্যাস না গল্প গ্রন্থ?
মোশাররফ হোসেন খান : বাংলাদেশে বর্তমান পরিবেশগত কারণে আমার প্রকাশকের সংখ্যাও সীমিত হয়ে এসেছে। যেমনটি হয়েছে আমার ক্ষেত্রে। তারপরও যেহেতু আমি চলমান একজন লেখক, সুতরাং দেখা যাক আল্লাহপাকের মঞ্জুর কি আছে।
বাংলা সাহিত্যের একটি বিশেষ ধারায় আপনি কাজ করছেন, এই ধারাটি কি অন্য ধারার চেয়ে দুর্বল? এর কারণ কি এই ধারার সাহিত্যিকরা প্রতিযোগিতায় পিছিয়ে না কি এর নেপথ্যে অন্য কোন কারণ আছে?
মোশাররফ হোসেন খান : আদর্শিক সাহিত্যধারা কখনই দুর্বল হতে পারে না। আমি এখনও দৃঢ় বিশ্বাস রাখি শেষ পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যে এই ধারাটিই বেঁচে থাকবে এবং বাংলা সাহিত্যের প্রতিনিধিত্ব করে যাবে। তবে এই ধারাটিকে আরও বেগবান করার জন্যে সচেতন মহলকে আন্তরিকতা ও পরিকল্পিতভাবে এগিয়ে আসতে হবে। যাঁরা এই ধারায় লিখছেন সব কিছু ত্যাগ করে, তাঁদেরকে লেখার সুযোগ করে দিতে হবে। সার্বিক পৃষ্ঠপোষকতা করতে হবে। সর্বোপরি আমাদের পত্র-পত্রিকাসহ প্রকাশনা বাড়াতে হবে।
আপনি একাধারে কবি, ছড়াকার, গীতিকার, প্রবন্ধকার, কথাসাহিত্যিক ও শিশুসাহিত্যিক। বলা চলে সাহিত্যের প্রায় সকল শাখাতে আপনার অবাধ বিচরণ। আপনি কি মনে করেন আপনি আপনার শ্রেষ্ঠ সাহিত্য কর্মটি সৃষ্টি করতে পেরেছেন? আপনার সৃষ্টি কর্মগুলোর মধ্যে আপনার প্রিয় সৃষ্টি কোনটি?
মোশাররফ হোসেন খান : আমার সাহিত্য জীবনটা আমি মনে করি আল্লাহরই দেয়া একটি বিশেষ নেয়ামত । আমি মহান রবের সেই নিয়ামত যথাযথভাবে কাজে লাগানোর চেষ্টা করি। সাহিত্য কর্মটিকে আমি একটি বড় ইবাদাতও মনে করি। কারণ আমিতো আল্লাহকে রাজি খুশি করার জন্য লিখি। মানুষের জন্য লিখি। সুন্দর সমাজ গড়ার জন্য লিখি। একটি সুন্দর পৃথিবীর স্বপ্ন দেখি ।
লিখতে লিখতেই তো জীবনের এতটা পথ এলাম । শ্রেষ্ঠ লেখাটি লিখতে পেরেছি কিনা জানিনা। আগামীতেও পারবো কিনা জানি না। কারণ কোনটি শ্রেষ্ঠ লেখা হবে সেটা কেবল মহাকালই নির্ধারণ করতে পারে। আমার শরীরের যেমন প্রতিটি অঙ্গই আমার প্রিয়, তেমনি আমার প্রতিটি লেখাই আমার অনেক বেশি প্রিয়। পৃথকভাবে শনাক্ত করা আমার পক্ষে সম্ভব নয় । হয়তো বা আমার পাঠকরা সেটা নির্বাচন করতে পারেন ।
আপনারা যে স্বপ্ন নিয়ে ঐতিহ্যিকধারার সাহিত্য আন্দোলন শুরু করেছিলেন তা আজ কতোটুকু সফল?
মোশাররফ হোসেন খান : আমাদের সময় পর্যন্ত আমরা সফল ছিলাম বলে মনে করি । কিন্তু এর পরে আমার মনে হয় না পরবর্তী যাত্রীরা সেই ধারাকে খুব একটা বেগবান করতে পেরেছেন। এর নানাবিধ কারণও থাকতে পারে ।
‘এ আঁধার থাকবে না চিরকাল/সহসা জেগে উঠবে সূর্য/উড়বেই বিজয়ের পাল।’- আপনার রচিত জনপ্রিয় এই গানটি এখন মানুষের মুখে মুখে। এ ব্যাপারে আপনার অনুভূতি কী?
মোশাররফ হোসেন খান : আমার পাঠক-শ্রোতা যদি এটাকে পছন্দ করে থাকেন তাহলে তো সেটা আমার জন্য খুবই আনন্দ এবং সৌভাগ্যের কথা। সকল প্রশংসা আল্লাহর ।
আপনার অনুজ তো অনেকেই লিখছেন কার লেখা আপনার বেশি ভালো লাগে?
মোশাররফ হোসেন খান : অনেকের লেখাই ভালো লাগে। আবার মনে হয় কেউ কেউ লেখায় খুব একটা মনোযোগ দিতে পারেন না। লেখার সময় অন্তত লেখার মধ্যেই নিজেকে ডুবিয়ে রাখলে ভালো হয়।
বাংলাদেশের বর্তমান সাহিত্য সম্পর্কে কিছু বলুন।
মোশাররফ হোসেন খান : এ ব্যাপারে খুব বেশি কথা বলতে ইচ্ছে হয়না । কারণ আগেই বলেছি সাহিত্য ও সাহিত্যিকও এখন রাজনীতির গ্যালারিতে পাক খাচ্ছে। ফলে আমাদের বিশেষ করে বাংলা কবিতার যে ধারটি ছিল ২০০০-এর পর সেটাও ম্রিয়মান হতে চলেছে । কষ্ট লাগে, বড় কষ্ট লাগে ।
আপনি বাংলাদেশের সবচেয়ে বহুল প্রচারিত একটি শিশুতোষ পত্রিকার সম্পাদক, শিশুদের নিয়েই তো আপনার কাজ। কিন্তু সেই শিশুরা তো আজ নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছে। যেমন-সিলেটের রাজন, খুলনার রাকিবসহ সাম্প্রতিককালে অনেক শিশু নির্যাতনের শিকার হয়ে মারা গেছে। এই যে সামাজিক অবক্ষয় দিন দিন বেড়ে চলেছে এর প্রতিকারে আপনি কী ভাবছেন?
মোশাররফ হোসেন খান : এটা অত্যন্ত দুঃখের বিষয়! শিশুরাই জাতির ভবিষ্যত। আমরা তাদেরকে নিয়ে স্বপ্ন দেখি। অনেক স্বপ্ন। তাদের জন্য মাথার ঘাম পায়ে ফেলি। তারা বড় হবে এটাইতো আমাদের কাম্য হওয়া উচিৎ। কেন তারা এভাবে নির্যাতিত হবে? কেন তারা নির্মম মৃত্যুর শিকার হবে? এটা শুধু সামাজিক অবক্ষয় বলে পার পাওয়ার উপায় নেই । এখানে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনার দায়-দায়িত্ব অনেক বেশি। সুতরাং আমি কি ভাবলাম তাদের নিয়ে এটা বড় কথা নয়, বড় কথা হলো শিশুদের সার্বিক নিরাপত্তার ব্যবস্থা করতে হবে। তাদেরকে যোগ্য করে গড়ে তুলতে হবে। সমাজ ও রাষ্ট্রের এটা একটি জরুরি কর্তব্য বলে মনে করি ।
আপনি তো মাসিক ‘নতুন কিশোরকণ্ঠে' সাহসী মানুষের গল্প নামে একটা ধারাবাহিক লিখতেন, এখন আর দেখি না কেন?
মোশাররফ হোসেন খান : হ্যাঁ, বহু বছর যাবৎ ‘সাহসী মানুষের গল্প' লিখেছি। সুযোগ ও পরিবেশ পেলে আবারও লিখবো ইনশাআল্লাহ ।
নবীন সাহিত্যকর্মীদের উদ্দেশে আপনার পরামর্শ কি?
মোশাররফ হোসেন খান : লিখতে গেলে একটি স্বপ্ন থাকতে হয়। একটি লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যও থাকা প্রয়োজন। একদিনেইতো আর লেখক হওয়া যায় না! এর জন্য চাই সাহিত্য সাধনায় সকল সময় মগ্ন থাকা। বেশি বেশি করে দেশি-বিদেশি গ্রন্থ পাঠ করা । নিজের লেখাটি নিয়ে বার বার নিজেই সমালোচনা করা। খ্যাতির জন্যে মরিয়া না হয়ে ভালো লেখার চেষ্টা করা।