৩ ডিসেম্বর, ২০২৫ ১৬:০৭ পি এম
পলিময় নদী আর সবুজ ছায়াঘেরা এক দেশের নাম বাংলাদেশ। ঋতুরঙ্গের প্রকৃতি, সোনালি ফসলের ঘ্রাণ, কৃষক-শ্রমিকের সংগ্রামী জীবন, লড়াই, গ্রামীণ সংস্কৃতি ও নগরায়ণের মাঝে বাংলাদেশ আবহমান কাল থেকে বিকশিত হয়ে বর্তমানে এসে পৌঁছেছে। কৃষিনির্ভর জীবন, নদী-বিল-হাওড়-সমুদ্রকেন্দ্রিক বৈচিত্র্যপূর্ণ জীবিকা, আদ্র জলবায়ু, সমৃদ্ধ ইতিহাস-ঐতিহ্যের ধারা এবং রূপময় প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এদেশের মানুষের মন, চিন্তা-ভাবনা ও সংস্কৃতির ধারা নির্মাণ করে। সোনার বাংলাদেশে পৃথিবীর বিভিন্ন দেশ থেকে বিভিন্ন সময়ে নানা জাতি-সম্প্রদায় এসেছে। এদেশের অনার্য জনসমাজে আর্য, আরব-তুর্কি-পাঠান-ইরানি, পর্তুগীজ-দিনেমার-ফরাসি-ইংরেজ ইত্যাদি জাতির আগমনে একটি সংকট জাতি ও ভাষা গড়ে ওঠে। তবে বাংলার সমৃদ্ধি, শান্তি ও সম্প্রীতি সবচেয়ে বেশি বৃদ্ধি পায় সুলতানী আমলে। মোগল আমলের আকর্ষণীয় স্থাপত্য এখনো সারা বাংলায় ছড়িয়ে আছে। বিশেষভাবে শায়েস্তা খানের সময়ে বাংলার প্রাচুর্য, ঐশ্বর্য ও দ্রব্যমূল্যের সুলভতার সুনাম আছে। আবার ঈশা খাঁর নেতৃত্বে বারো ভূঁইয়াদের প্রতিরোধ যুদ্ধের ইতিহাস আমাদের সাহস জোগায়। নবাবী আমলের শেষদিকে স্থানীয় রাজন্যবর্গের সহযোগিতায় ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শক্তি ষড়যন্ত্র করে দেশের স্বাধীনতা, সম্পদ ও অধিকার কেড়ে নেয়। প্রায় দুইশত বছর লড়াই-সংগ্রাম করে কাঙ্ক্ষিত মুক্তি আসে; ১৯৪৭ সালে স্বাধীনতা লাভের পর আবার স্বৈরতান্ত্রিক শাসনে আবদ্ধ হয়ে স্বায়ত্তশাসন ও মুক্তিসংগ্রামের একপর্যায়ে রক্তাক্ত যুদ্ধের মাধ্যমে ১৯৭১-এ অর্জিত হয় লাল সবুজের পতাকা। নব্বইয়ে আবার স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে অভ্যুত্থান সংঘটিত হয় এবং গণতান্ত্রিক ধারায় দেশ চলতে থাকে। কিন্তু গত তিনটি নির্বাচন (২০১৪, ২০১৮ ও ২০২৩) নামে ভাঁওতাবাজি ও জনগণের সাথে প্রতারণা করে একদলীয় ফ্যাসিবাদী দুঃশাসন কায়েম করা হয়। দেড় দশকের সমস্ত অন্যায়, জুলুম, খুন-গুম, সম্পদ পাচার ও অধিকার হরণের প্রতিবাদে মানুষ একসময় জেগে ওঠে। ইতিহাসের নতুন এক অধ্যায়ের সূচনা হয় জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে।
দুই
ইতিহাসের ধারা ও মানবসমাজ সব সময় সামনের দিকে এগিয়ে যায়; পেছনের দিকে ধাবমান হয় না। আধুনিককালে কোনো নাগরিক সমাজ এ-ধরনের বিপরীতমুখী ধারায় চলতে পারে না। গোলকায়নের যুগে মৌলিক মানবাধিকার, ন্যায় ও সমতাভিত্তিক কল্যাণ রাষ্ট্রের স্বপ্ন ও গণতান্ত্রিক আকাঙ্ক্ষা এখনকার সমাজে বিরাজমান। বিশেষভাবে বাংলাদেশের মতো রাষ্ট্রে জনগণ ক্ষমতাকাঠামোর নানামুখী কলকজার অপব্যবহারে অধিকারহারা, পরাধীন ও নির্যাতিত। ব্রিটিশ সাম্রাজ্যের বিরুদ্ধে স্বাধীনতার দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রাম, পাকিস্তানী শাসন থেকে মুক্তির অবিরাম পথচলা এবং মুজিব-হাসিনার ফ্যাসিবাদ ও মাফিয়াতন্ত্র থেকে গণতান্ত্রিক ও স্বাধীন বাংলাদেশ পাওয়ার জন্য নিরন্তর রক্তক্ষয়ী গণ-আন্দোলন ও গণ-অভ্যুত্থানের মাধ্যমে আমরা বর্তমান বাংলাদেশ পেয়েছি। দীর্ঘ দেড় দশকে জনগণের সমস্ত অধিকার হরণ, ভিন্ন মতকে নিষ্ঠুরভাবে দমন-পীড়ন ও গণহত্যা, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ছিনতাই ও দেশের সম্পদ অবৈধভাবে কুক্ষিগত করে বিদেশে পাচারের মধ্য দিয়ে দেশকে একটা নরকে পরিণত করে। ফলে ক্রমাগত গণক্ষোভ ও বিক্ষোভ দানা বাঁধতে থাকে; মধ্য জুলাই থেকে, বিশেষভাবে আবু সাঈদের বীরত্বপূর্ণ শাহাদাতবরণসহ বেশ কয়েকজনের শহীদ হওয়ার ঘটনা সারা দেশে গণজোয়ারের সৃষ্টি হয়; ফ্যাসিবাদী সরকার গণহত্যা চালালে তা গণ-অভ্যুত্থানে রূপ নেয়; অবশেষে ৩৬ জুলাই/৫আগস্ট কাঙ্ক্ষিত বিজয় আসে। এখন আমাদের এই অভ্যুত্থানকে সংহত করতে ও আগামীর বাংলাদেশ নির্মাণে সংবিধান, রাষ্ট্রব্যবস্থা, শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির পুরাতন কাঠামো ভেঙে জুলাই বিপ্লবের চেতনায় উজ্জীবিত নতুন ভিত্তি নির্মাণ একান্ত প্রয়োজন।
তিন
পশ্চিমা দুনিয়ায় আমরা দেখেছি- বিশ শতকে জার্মানিতে পৃথিবীর অন্যতম নিষ্ঠুর ফ্যাসিবাদী শাসক হিটলারের পতন এবং ফ্যাসিবাদী দুঃশাসনের আদর্শ মুসোলিনির করুণ পরাজয়। তারও আগে আঠারো শতকে ফরাসি দেশের অত্যাচারী রাজা চতুর্দশ লুইয়ের রাজত্বকালে বাস্তিল দুর্গের পতনের মধ্য দিয়ে ফরাসি বিপ্লব সংঘটিত হয়। রাজা ষোড়শ লুই ও রানি মেরিকে গিলোটিনে চড়িয়ে মৃত্যুদণ্ড কার্যকর করা হয় এবং দেশের বীর জনতার বিপ্লবের মধ্য দিয়ে ফ্রান্সে রাজতন্ত্রের অবসান হয়। মানুষ মুক্তির স্বাদ গ্রহণ করে। আবার বলশেভিক ও ইরানি বিপ্লব আধুনিক পৃথিবীকে বিস্মিত করে প্রতিষ্ঠিত মানবতাবিরোধী শক্তিকে পরাজিত করে। এইসব বিপ্লবের চেতনা বিভিন্ন সময়ে বিশ্বের নানা প্রান্তে প্রেরণা যুগিয়েছে স্বৈরাচারী সরকারের বিরুদ্ধে লড়াই করতে।
বাংলাশের মানুষ ১৮৫৭ সালে সিপাহী বিপ্লবে অংশ নিয়ে ব্রিটিশ সাম্রাজ্যবাদী শক্তির বিরুদ্ধে রক্তাক্ত যুদ্ধ করে। এই বিপ্লবের ঢেউ দীর্ঘ লড়াই-সংগ্রামের পর ১৯৪৭ সালে আমাদের প্রথম স্বাধীনতা নিয়ে আসে। আবার পাকিস্তানের বঞ্চনার বিরুদ্ধে তেইশ বছরের আন্দোলন ও যুদ্ধের পর ১৯৭১-এ দ্বিতীয় স্বাধীনতা অর্জিত হয়। চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থান বিগত দেড় দশকের ফ্যাসিবাদী দুঃশাসন, ভারতীয় আধিপত্যবাদ, গুম, গণহত্যা, শোষণ, নির্যাতন, নিপীড়ন, সীমাহীন দুর্নীতি, লুটপাটের বিরুদ্ধে সর্বশ্রেণি, বয়স ও পেশার জনগণের অভূতপূর্ব প্রতিরোধ লড়াই। পৃথিবীর ইতিহাসে এক বিস্ময়কর ও গৌরবোজ্জ্বল অধ্যায়ের সূচনা হয়েছে। জনগণের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও সর্বপ্রকার অধিকার হরণের বিরুদ্ধে নতুন এক সম্ভাবনার বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছে। গণ-আন্দোলনে স্বৈরতন্ত্রের ঐতিহাসিক পতনের মাধ্যমে বাংলদেশের জনগণ আর্থসামাজিক, রাজনৈতিক, সাংস্কৃতিক বিন্যাস ও পটভূমির আলোকেই আজ এক নতুন জাগরণের জন্ম দিয়েছে। আধিপত্যবাদী ভারতের রাজনৈতিক প্রভাবের নিকৃষ্ট চর্চা আমরা থামিয়ে দিতে পেরেছি; কিন্তু সাংস্কৃতিক স্বকীয়তা ও স্বাধীনতা এখনো অনেক দূর।
চার
আলজেরিয়ার মুক্তিসংগ্রামের অন্যতম নায়ক ফ্রাঞ্জ ফানো ‘জগতের লাঞ্ছিত’ (ঞযব ৎিবঃপযবফ ড়ভ ঃযব ঊধৎঃয) গ্রন্থে বলেন: ‘জনগণের সম্মিলিত প্রচেষ্টায় যে-জাতির জন্ম, যা জনগণের সত্যিকার আশা-আকাঙ্ক্ষার প্রতিভূ, রাষ্ট্র পরিবর্তনের সময় সে যদি সংস্কৃতির বিশেষভাবে ঋদ্ধ-ফর্মে তার বহিঃপ্রকাশ না ঘটায়, তার নিজের অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে পারে না।... জাতীয় সংস্কৃতির ভবিষ্যৎ এবং প্রাণপ্রাচুর্য সমভাবে মুক্তিসংগ্রাম সৃষ্টিকারী মূল্যবোধেরই অভিন্ন অংশ।’ সুতরাং চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানে নির্ধারণ হয়ে গেছে বর্তমান নতুন এক বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অভিযাত্রা। যে যাত্রা শুরু করেছিলেন মনীষী আবুল মনসুর আহমদ। আবুল মনসুর আহমদ মনে করেন পূর্ববাংলার জনগোষ্ঠী নবীন বা শিশু না; কিন্তু জাতিরাষ্ট্র হিসেবে নতুন। প্রাচীন সমতটের পলিময় এই দেশের দুই হাজার বছরের গৌরবময় ইতিহাস আছে। তিনশ’ বছর আগেও বাংলাদেশ শিক্ষা, সংস্কৃতি ও সভ্যতার পীঠস্থান, ব্যবসা-বাণিজ্যের কেন্দ্র, সভ্য জাতির জ্ঞানীদের তীর্থক্ষেত্র হিসেবে সম্মানজনক অবস্থানে ছিলো। এই দেশের মাটির সাথে জনগণের সম্পর্ক হাজার বছরেরও অধিককাল। আধুনিকতম ধর্মের অনুসারী বা মুসলিম হিসেবে আমরা সাড়ে ছয়শ’ বছর এই অঞ্চলের শাসক ছিলাম। এর মধ্যে প্রায় তিনশ’ বছর বাংলা-বিহার-উড়িষ্যার শাসন আমরা করেছি। ‘বাংলাদেশের কালচার’ গ্রন্থে তিনি বলেন-
আমরা বাংলাকে নিজস্ব জাতি- নাম, ভাষা ও সাহিত্য দিয়াছিলাম। সে ভাষা ও সাহিত্যের মধ্য দিয়া বাঙ্গালীত্বকে নতুন মর্যাদা, তার ভাষায় নতুন সুর, তার গলায় নতুন জোর দিয়াছিলাম। কৃষ্টি-সভ্যতা, শিল্প-বাণিজ্য ও শিক্ষা-সাহিত্যে সভ্য জগতের দরবারে বাংলাদেশকে করিয়াছিলাম সুপ্রতিষ্ঠিত। বাংলার শিল্প-সাহিত্যে ও কৃষ্টি-সভ্যতায় হাজার বছরের এই মুসলিম ছাপ সুস্পষ্ট দীপ্তমান।
ঐতিহাসিক কালপরিক্রমায় পূর্ববাংলার জনগণের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্য যেমন গৌরবোজ্জ্বল; তেমনি এখানকার সভ্যতাও হাজার বছরের পুরোনো, সমৃদ্ধ ও সুদীপ্ত; সেইসাথে এই কৃষ্টি-সভ্যতায় ‘মুসলিম ছাপ’ গুরুত্বপূর্ণ স্মারক। সংস্কৃতির প্রশ্নটি আবুল মনসুর জাতি হিসেবে গড়ে ওঠার প্রধান নিয়ামক শক্তি হিসেবে দেখেছেন। একটি নতুন রাষ্ট্রের নতুন জাতির ভিত্তি নির্মাণের প্রধান স্তম্ভ সংস্কৃতির দিক নির্ণয়, স্বরূপ বিশ্লেষণ ও শক্তিশালীকরণে জাতীয় কর্তব্য পালনে অগ্রণী ও বিরল ভূমিকা রাখেন লেখক। ‘চিন্তা-নায়ক’ সাহিত্যিকদের সৃজন ও মননে অনুকরণ নয়, আত্মচেতন-আত্মবিশ্বাসী-আত্মমর্যাদাসম্পন্ন নিজস্ব সংস্কৃতি বিনির্মাণে কার্যকর ও ঐতিহাসিক ভূমিকা রাখার তাগিদ দিয়েছেন। একইসাথে ‘কৃষ্টিক উপনিবেশ’ থেকে মুক্ত হয়ে পূর্ববাংলা বা ঢাকাকেন্দ্রিক নতুন ভাষা কাঠামোয় নতুন সাহিত্য সৃষ্টির প্রত্যয়। ভাষা ও সাহিত্যে প্রভাব কলিকাতার বদলে ঢাকা হবে। ব্রিটিশ উপনিবেশ থেকে সদ্য মুক্ত হওয়া একটি দেশ- যার প্রতিবেশী রাষ্ট্রও রাজনৈতিকভাবে আধিপত্যবাদী ও সাংস্কৃতিক আগ্রাসনে অগ্রণী, বর্তমানের কৃষ্টিক সংকট মোকাবেলা এবং আগামীর পথরেখা নির্ণয়ে আবুল মনসুর আহমদের ভূমিকা ঐতিহাসিক, বাস্তবসম্মত, অভিভাবকতুল্য ও দূরদর্শী। ভারতীয় উপমহাদেশের ঐতিহাসিক বিকাশধারায় বর্তমান পূর্ব-বাংলার ‘জাতীয় কৃষ্টি নির্মাণ-প্রকল্প’ হাজির করেন- যৌক্তিক, বৌদ্ধিক ও বাস্তবিক দৃষ্টিতে। চলমান বিশ্ব-পরিস্থিতি, সমাজ বাস্তবতা, কালের চাহিদা এবং জ্ঞান-বিজ্ঞানের অগ্রগতির কথা বিবেচনা করে লেখক সাংস্কৃতিক জাগরণের প্রত্যাশিত রূপ প্রগতিশীল, আধুনিক ও বৈজ্ঞানিক হবে বলে আশা প্রকাশ করেন। সেইসাথে ঢাকাকেন্দ্রিক নতুন রাষ্ট্রে ‘জাতীয় সাহিত্য’ সৃষ্টি করতে হবে পূর্ব-বাংলার জনজীবনের বিন্যাস এবং গণমানুষের স্বতন্ত্র ভাষা ও স্বরভঙ্গির সমন্বয়ে। মানে কাঙ্ক্ষিত রেনেসাঁর স্বরূপ, প্রকৃতি ও ফল কেমন হবে তাও সুস্পষ্টভাবে প্রকাশ করেন। বাংলাদেশই যে ‘বাংলার ভাষা ও সংস্কৃতি’র সূতিকাগার তা ব্যক্ত করেন লেখক।
পাঁচ
চব্বিশের জুলাই অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশকেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক মুক্তির রূপরেখা প্রণয়নে ও গণমুক্তির নতুন বয়ান নির্মাণে সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক উপাদানের ভূমিকা অনন্য। গান, কবিতা, তথ্যচিত্র, গ্রাফিতি, দেয়াল লিখন, স্মৃতিকথা, গল্প-উপন্যাস ও মননশীল প্রবন্ধ অভ্যুত্থানের স্পিরিটকে প্রকাশ করেছে ও ছড়িয়ে দিয়েছে গণমাধ্যমে ও গণমানুষের মনেপ্রাণে। দেয়াল লিখনে তারুণ্যের যে শ্লোগান অঙ্কিত হয়েছে সেখানে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মালিকানা নির্ধারণ ও ফ্যাসিবাদকে চ্যালেঞ্জ উপস্থাপিত হয়েছে। একদিকে ভারতীয় আধিপত্যবাদ ও বাকশালী ফ্যাসিবাদ মোকাবেলা; অন্যদিকে নতুন স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষার বাংলাদেশ নির্মাণের রঙ-রেখার প্রতিচ্ছবি দৃশ্যমান হয়েছে সমগ্র দেশে। দেয়াল লিখনে তারুণ্যের যে শ্লোগান অঙ্কিত হয়েছে সেখানে বাংলাদেশ রাষ্ট্রের মালিকানা নির্ধারণ ও ফ্যাসিবাদকে চ্যালেঞ্জ উপস্থাপিত হয়েছে। একদিকে ভারতীয় আধিপত্যবাদ ও বাকশালী ফ্যাসিবাদ মোকাবেলা; অন্যদিকে নতুন স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষার বাংলাদেশ নির্মাণের রঙ-রেখার প্রতিচ্ছবি দৃশ্যমান হয়েছে সমগ্র দেশে। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র-আন্দোলনের নেতৃত্বে পরিচালিত অভ্যুত্থানে বহুল উচ্চারিত কয়েকটি শ্লোগান:
‘আমার সোনার বাংলায় বৈষম্যের ঠাঁই নাই’;
‘জাস্টিস জাস্টিস, উই ওয়ান্ট জাস্টিস’;
‘তোর কোটা তুই নে, আমার ভাই ফিরিয়ে দে’
‘লাশের ভিতর জীবন দে, নইলে যদি ছাইড়া দে’
এক দুই তিন চার/ শেখ হাসিনা গদি ছাড়;
‘আমার খায়, আমার পরে, আমার বুকেই গুলি করে;
লেগেছে রে লেগেছে/ রক্তে আগুন লেগেছে;
আমি কে তুমি কে/ রাজাকার রাজাকার;
কে বলেছে কে বলেছে/ স্বৈরাচার স্বৈরাচার;
রাজা কার?/ জনতার জনতার;
আপোষ না সংগ্রাম/ সংগ্রাম সংগ্রাম;
দালালি না রাজপথ/ রাজপথ রাজপথ;
ক্ষমতা না জনতা/ জনতা জনতা;
চলছে লড়াই চলবে/ চলছে লড়াই চলবে;
আবু সাঈদ মুগ্ধ/ শেষ হয়নি যুদ্ধ;
আমাদের ধমনীতে শহীদের রক্ত/
সেই রক্ত কোনদিনই/ পরাজয় মানে না।
শ্লোগানের বজ্রাঘাতে আগ্রাসী-ঘাতক সরকারের ভিত কেঁপে যায় এবং আমজনতা বুকের মাঝে শক্তি ও সাহস ফিরে পায়। এইসব শ্লোগানের প্রেরণা ও গণক্ষোভের বিস্ফোরণে ছাত্র-জনতার অভাবনীয় রক্তাক্ত অভ্যুত্থানে দীর্ঘ দেড় দশকের ফ্যাসিবাদী ও আধিপত্যবাদী শক্তির কবল থেকে বাংলাদেশ সার্বত্রিক মুক্তির আকাঙ্ক্ষা ও স্বপ্ন প্রকাশিত। নতুন স্বপ্ন, সম্ভাবনা, সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক রূপান্তর, প্রতিবাদ-দ্রোহ-স্বাধীনতা, ব্যঙ্গ ও উদ্দীপনার প্রতিনিধিত্বশীল গ্রাফিতি, দেয়ালচিত্র, দেয়াল লিখন, আর্ট ও ক্যালিগ্রাফির রঙ-রেখা-রূপের প্রতিচ্ছবি বাংলাদেশময় ছেয়ে যায়। গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা ও স্পিরিট ধারণ করে বিদ্যমান ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থাকে ভেঙে নয়া জন-অভিপ্রায় এইসব শিল্পভাষ্যে বাক্সময় হয়ে ওঠে।
বল বীর/চির উন্নত মম শির;
আমরাই গড়বো নতুন দেশ
ভয়ের দেয়াল ভাঙলো এবার/জোয়ার এলো ছাত্র জনতার;
আমরা নয় তো একজন/আমরা কয়েকজন;
রক্ত গরম/ মাথা ঠাণ্ডা;
হীরক রাণীর দেশে;
স্বাধীনতা এনেছি যখন/ সংস্কার করি;
সুবোধ সকাল হয়ে গেছে;
বুকের ভেতর অনেক ঝড়/ বুক পেতেছি গুলি কর;
আমরা ইন্টারনেট বন্ধ করিনি; বন্ধ হয়ে গেছে;
বাংলাদেশ ২.০।
এই শহর হোক সকল প্রাণির
মোরা ঝঞ্ঝার মতো উদ্দাম
রক্ত দিয়ে অর্জিত নতুন সূর্য
প্রতিবাদ হোক ন্যায়ের জন্য
বাংলার বুকে বিজয়ের পতাকা উড়বে চিরকাল
চিত্র ও চিত্রকল্প, রঙ ও রেখা, রূপ ও দৃশ্যকল্প মিলিয়ে যে পেন্টিং তা দেশের গ্রাফিতি ও দেয়ালচিত্রে নতুন এক বাংলাদেশের অভ্যুদয় ঘটেছে। ফ্যাসিবাদ থেকে মুক্তি, আধিপত্যবাদ থেকে স্বাধীনতা, শৃঙ্খল থেকে জাগরণ, খুন-গুম থেকে নিরাপত্তা, দুর্নীতি-পাচার থেকে দেশপ্রেম, হতাশা থেকে স্বপ্ন, বন্ধ্যাত্ব থেকে সম্ভাবনার রূপান্তরের ভাষা প্রাণবন্ত হয়ে ওঠে গ্রাফিতি ও দেয়াল লিখনে। অন্যদিকে মুসলিম সংস্কৃতির অংশ হিসেবে ক্যালিগ্রাফি নতুন আলোয় উদ্ভাসিত ও বর্ণিলরূপে হাজির হয়েছে। এ এক নতুন স্বপ্ন ও সম্ভাবনার রঙিন বাংলাদেশ। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের অগ্নিঝরা গান জনমনে প্রেরণা ও সাহস সঞ্চার করে; মিছিলে শ্লোগানে নতুন ব্যঞ্জনায় জনমনে প্রতিরোধের আগুন জ্বালিয়ে দেয় বহুগুন:
কারার ঐ লৌহ-কবাট
ভেঙে ফেল, কর রে লোপাট
রক্ত-জমাট
শিকল-পুজোর পাষাণ-বেদী!
অথবা-
বল রে বন্য হিংস্র বীর,
দুঃশাসনের চাই রুধির।
দুঃশাসনের রক্ত চাই!
দুঃশাসনের রক্ত চাই!!
নবারুণ ভট্টাচার্যের কালজয়ী উচ্চারণ-
এই মৃত্যু উপত্যকা আমার দেশ না
এই জল্লাদের উল্লাসমঞ্চ আমার দেশ না
এই বিস্তীর্ণ শ্মশান আমার দেশ না
এই রক্তস্নাত কসাইখানা আমার দেশ না
এই বিদ্রোহ ও প্রতিরোধের সাথে সম্মিলিত কণ্ঠে বেজে উঠেছে চিরস্মরণীয় দেশকে ভালোবাসার গান:
ধনধান্য পুষ্পভরা আমাদের এই বসুন্ধরা
তাহার মাঝে আছে যে এক সকল দেশের সেরা
ও সে স্বপ্ন দিয়ে তৈরি সে দেশ স্মৃতি দিয়ে ঘেরা
এমন দেশটি কোথাও খুঁজে পাবে নাকো তুমি
সকল দেশের রাণী সে যে আমার জন্মভূমি
সে যে আমার জন্মভূমি/ সে যে আমার জন্মভূমি ।
একইসাথে সমকালীন কবিদের কবিতাও উচ্চারিত ও উচ্চকিত হয়েছে নানাভাবে ও আঙ্গিকে। ১৭৫৭ সালে অস্তমিত বাংলার স্বাধীনতার সূর্য ফিরিয়ে আনতে ১৯০ বছর ধরে রক্তক্ষয়ী লড়াই-সংগ্রাম করতে হয়েছে জনগণকে; ১৯৪৭ সালে আজাদী আসার পর আবার মুক্তির জন্য ২৩ বছর আন্দোলন-যুদ্ধ করে ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা অর্জিত হলেও বাকশালী দুঃশাসন কায়েম হয় এবং গত ১৫ বছর ফ্যাসিবাদী রাষ্ট্রব্যবস্থায় জনগণ সম্পূর্ণ অধিকার ও মানবিক মর্যাদা হারিয়ে ফেলে। গণতন্ত্র ও সুশাসনের বদলে ফ্যাসিবাদ, গণহত্যা, খুন-গুম ও মাফিয়াতন্ত্র চালু করে স্বাধীনতা, ভোটাধিকার ও সম্পদ হরণের ফলে জনগণের ক্ষোভের বারুদ প্রস্তুত হয়ে ছিলো। ১-৩৬ জুলাই সংঘটিত ঘটনাপ্রবাহ সেই বারুদে অভ্যুত্থানের দেশলাই জ্বেলে দেয়। গণরোষ ও গণক্ষোভ এই সময়ে বিস্ফোরণ ঘটে সকল শ্রেণি-পেশা-বয়স-লিঙ্গভেদে। অকাতরে জীবন দিয়ে গণশত্রু মোকাবেলা করে নতুন বাংলাদেশের স্বপ্নপূরণে জুলাই যোদ্ধা ও শহীদ যে মহত্ব ও গৌরব অর্জন করেছে তাকে ধারণ করেই আগামীর ইনসাফপূর্ণ সমাজ বিনির্মাণে সম্মিলিতভাবে কাজ করতে হবে।
ছয়
চব্বিশের জুলাই অভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশকেন্দ্রিক সাংস্কৃতিক মুক্তির রূপরেখা প্রণয়নে আমাদের কাজ করতে হবে। আধিপত্যবাদী শক্তির মদদে পালিত ফ্যাসিবাদী দুঃশাসনের প্রতিষ্ঠিত বয়ান ভেঙে গণমুক্তির নতুন বয়ান নির্মাণ করতে হবে। সারা দেশের দেয়ালে দেয়ালে তারুণ্যের যে গ্রাফিতি ও শ্লোগান অঙ্কিত হয়েছে সেখানেই আমাদের বর্তমান সাংস্কৃতিক ও রাজনৈতিক স্বপ্ন ও অভিপ্রায় প্রতিফলিত। গ্রাফিতির রঙ-রেখা-রূপের মাঝে গণ-অভ্যুত্থানের আকাঙ্ক্ষা বর্তমান। উচ্চকণ্ঠে উচ্চারিত শ্লোগানের মাঝে প্রতিষ্ঠিত বয়ানের ভাঙন ও নতুন ন্যারেটিভের জন্ম হয়েছে যা আগামীর বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক অভিযাত্রা সম্পন্ন হবে। শ্লোগানের প্রেরণা ও গণক্ষোভের বিস্ফোরণে ছাত্র-জনতার অভাবনীয় রক্তাক্ত অভ্যুত্থানে দীর্ঘ দেড় দশকের ফ্যাসিবাদী ও আধিপত্যবাদী শক্তির কবল থেকে বাংলাদেশ রাজনৈতিক মুক্তি অর্জন করলেও সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক মুক্তি আসেনি। এক্ষেত্রে নতুন পরিকল্পনা ও কর্মসূচি নিয়ে আমাদের কাজ করতে হবে। পুরাতন বয়ানের পরাজয়ে নতুন বয়ানের ভিত্তিতে গড়ে উঠবে বাংলাদের স্বাধীন সংস্কৃতির ধারা। বাংলার প্রতিরোধের ইতিহাসে তিতুমীর-শরীয়তুল্লাহর লড়াই, ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, সিপাহি বিপ্লব আর আমাদের মহত্তম সংগ্রাম মুক্তিযুদ্ধের প্রেরণায় গড়ে তুলতে হবে আগামী বাংলাদেশের অন্তর্ভুক্তিমূলক সাংস্কৃতিক রূপরেখা। জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলামের সাম্রাজ্যবাদ ও উপনিবেশবাদ বিরোধী বিপ্লবী ও স্বাধীন দর্শনের আলোকে এই সংস্কৃতির পাটাতন নির্মাণ অতি জরুরি।
লেখক: কবি, গবেষক ও সম্পাদক।