২৩ মার্চ, ২০২৫ ১১:০৮ এএম
রোযা ও রমযান মাস পুরোটাই বরকতময়। আল্লাহ তায়ালা বলেন, রোযা আমার জন্যই। আমি নিজ হাতে এর প্রতিদান দেব অথবা আমি নিজেই উহার প্রতিদান। (বুখারি, ৭৪৯২) রোযার কাঙ্খিত ফল পেতে হলে আমাদিগকে তা যথাযথভাবে আদায় করতে হবে। রোযার সাথে এমন কিছু আমল আছে যা আমরা অজানা/অবহেলায় পরিত্যাগ করছি। এমন কিছু কাজ বা আমল সম্পর্কে নিম্নে উল্লেখ করা হলো:
১. রোযাদারের সাথে কেউ ঝগড়া করলে এ কথা বলতে হবে ‘আমি রোযাদার’
ঝগড়া-বিবাদ, গালি-গালাজ থেকে বিরত থাকা রোযার একটি গুরুত্বপূর্ণ বিধান। রোযাহীন অবস্থায়ও তা নিষিদ্ধ, আর রোযা অবস্থায় আরও মারাত্মক। তাই রোযা অবস্থায় কেউ তাকে গালি দিলে তার করণীয় কি? এ প্রসঙ্গে হাদিসে এসেছে:
১. আবূ হুরাইরা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যখন তোমাদের কারো রোযার দিন হবে, সে যেন অশ্লীল ভাষা প্রয়োগ না করে ও হৈ-হট্টগোল না করে। আর যদি কেউ গালাগালি করে অথবা তার সাথে লড়াই ঝগড়া করে, তাহলে সে যেন বলে যে, ‘আমি রোযাদার।”(সহিহ বুখারি, ১৮৯৪, ১৯০৪; তিরমিযি ৭৬৪, ৭৬৬)
২. আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত: রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, রোযা (একটি) ঢাল, কাজেই তোমাদের যে কেউ রোযাদার হও, সে বাজে কথা বলবে না এবং বর্বরতার কাজ করবে না। যদি কোনো ব্যক্তি তাকে গালি দেয় অথবা কাটাকাটি-মারামারি করতে আসে, তবে সে যেন বলে, আমি রোযাদার, আমি রোযাদার। (সহিহ বুখারি, ১৮৯৪; মুয়াত্তা মালিক ৬৭৩)
৩. আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: তোমাদের প্রতিপালক বলেন, “প্রতিটি সৎ কাজের প্রতিদান হলো দশ গুণ হতে সাত শত গুণ পর্যন্ত। কিন্তু রোযা শুধুমাত্র আমার জন্যই এবং এর প্রতিদান আমি নিজেই দিব।” রোযা জাহান্নাম হতে (বাঁচার) ঢালস্বরূপ। আল্লাহ্ তা’আলার নিকট রোযা পালনকারীর মুখের গন্ধ কন্তুরী ও মিশ্ক আম্বরের গন্ধের চেয়েও অধিক পছন্দনীয়। তোমাদের কোনো রোযা পালনকারীর সাথে যদি কোনো জাহিল মূর্খতা সুলভ আচরণ করে তবে সে যেন বলে, আমি রোযাদার। (তিরমিযি, ৭৬৪; সহিহ আবূ দাঊদ ২০৪৬)
সুতরাং রোযাদার ব্যক্তির জন্য শোভনীয় হবেনা পরিবারের ছোট-বড় কারও সঙ্গে দুর্ব্যবহার করা; বরং সবার সঙ্গে সদ্ব্যবহার করা উচিত। পরিচিত-অপরিচিত যে কোনো লোকের প্রতি কটূবাক্য, জুলুম, নির্যাতন, গালিগালাজ ইত্যাদিতে লিপ্ত হলে সে রোযা তাকে জাহান্নাম হতে রক্ষা করবে না। প্রত্যেক রোযাদার যদি রোযার এই গুরুত্বপূর্ণ বিধান (ঝগড়া বিবাদ পরিহার) মেনে চলেন, তবে সমাজে শান্তি ও সৌহার্দ্য প্রতিষ্ঠিত হবে, যেমন হয়েছিল রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম ও খোলাফায়ে রাশেদার যুগে।
তাই রোযা অবস্থায় কেউ গালি দিলেও তার জবাবে গালি দেয়া যাবে না। কেউ মারামারি কিংবা ঝগড়া-বিবাদ করতে চাইলেও তা এড়িয়ে চলতে হবে। রাসুলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম হাদিসে আমাদের এমন নির্দেশ দিয়েছেন, এটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর সুন্নাহ।
২. রোযায় শ্রমিকদের কাজ হাল্কা করে দেয়া
আমাদের দেশে অধিকাংশ মানুষ রোযাদার শ্রমিকদের কাছ থেকে তাদের কাজ ষোল আনাই বুঝে নিয়ে থাকেন। এ ব্যপারে কোনো ছাড় দেন না। তা ঠিক নয়। হাদিসে অধিনস্ত লোকদের রোযা অবস্থায় কাজের চাপ কমিয়ে দেয়ার কথা বলা হয়েছে। এটি একটি উত্তম আমল, এতে গুনাহ মাফ হয়। হাদিসে এসেছে:
সালমান আল ফারিসী থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন, শা‘বান মাসের শেষ দিনে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমাদেরকে উদ্দেশ্য করে ভাষণ দিলেন। তিনি বললেন, হে লোক সকল! একটি মহিমান্বিত মাস তোমাদেরকে ছায়া হয়ে ঘিরে ধরেছে। এ মাস একটি বারাকাতময় মাস। এটি এমন এক মাস, যার মধ্যে একটি রাত রয়েছে, যা হাজার মাসের চেয়ে উত্তম। আল্লাহ এ মাসের সিয়াম ফরয করেছেন আর নাফল করে দিয়েছেন এ মাসে রাতের কিয়ামকে। যে ব্যক্তি এ মাসে একটি নাফল কাজ করবে, সে যেন অন্য মাসের একটি ফরয আদায় করল। আর যে ব্যক্তি এ মাসে একটি ফরয আদায় করেন, সে যেন অন্য মাসের সত্তরটি ফরয সম্পাদন করল। এ মাস সবরের (ধৈর্যের) মাস; সবরের সাওয়াব জান্নাত। এ মাস সহমর্মিতার। এ এমন এক মাস যাতে মু’মিনের রিযক বৃদ্ধি করা হয়। যে ব্যক্তি এ মাসে কোনো রোযাদারকে ইফতার করাবে, এ ইফতার তার গুনাহ মাফের কারণ হবে, হবে জাহান্নামের অগ্নিমুক্তির উপায়। তার সাওয়াব হবে সায়িমের অনুরূপ। অথচ সায়িমের সাওয়াব একটুও কমানো হবে না।
আমরা বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমাদের সকলে তো রোযাদারের ইফতারীর আয়োজন করতে সমর্থ নয়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন: এ সাওয়াব আল্লাহ তা‘আলা ঐ ইফতার পরিবেশনকারীকেও প্রদান করেন, যে একজন সায়িমকে এক চুমুক দুধ, একটি খেজুর অথবা এক চুমুক পানি দিয়ে ইফতার করায়। আর যে ব্যক্তি একজন সায়িমকে পেট ভরে খাইয়ে পরিতৃপ্ত করল, আল্লাহ তা‘আলা তাকে আমার হাওযে কাওসার থেকে এভাবে পানি খাইয়ে পরিতৃপ্ত করবেন, যার পর সে জান্নাতে (প্রবেশ করার পূর্বে) আর পিপাসার্ত হবে না। এমনকি সে জান্নাতে প্রবেশ করবে। এটা এমন এক মাস যার প্রথম অংশে রহমত। মধ্য অংশে মাগফিরাত, শেষাংশে জাহান্নামের আগুন থেকে নাজাত। যে ব্যক্তি এ মাসে তার অধিনস্তদের ভার-বোঝা সহজ করে দেবে, আল্লাহ তাকে ক্ষমা করবেন। তাকে জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তি দেবেন।(য‘ঈফ আত্ তারগিব ৫৮৯; ইবনু খুযায়মাহ্ ১৮৮৭; শু‘আবূল ঈমান ৩৩৩৬)
৩. সাহরিতে খেজুর খাওয়া
দেশ ও অঞ্চলভেদে সাহরিতে খাবারের ধরন ভিন্ন হয়ে থাকে। সাহরিতে আমরা অনেক ধরনের খাবার খেয়ে থাকি। কিন্তু রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম যা খেতে বলেছেন ও খেয়েছেন তা আমরা অনেকেই খাই না। আসলে আমরা জানিই না, রাসূল কি খেয়েছেন? তা হলো খেজুর। অন্তত দুই একটা খেলেও তো এ সুন্নাতটা পালন হয়। হাদিসে এসেছে:
সুনানে আবু দাঊদ-এর কয়েকটি বর্ণনায়-খেজুরকে সর্বোত্তম সাহরি বলেছেন রাসুল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম। তন্মধ্যে ১ টি সহিহ হাদিস হলো:
আবূ হুরায়রাহ্ রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন: মু’মিনের জন্য সাহরির উত্তম খাবার হলো খেজুর।(আবূ দাঊদ, ২৩৪৫; সুনানুল কুবরা লিল বায়হাকী ৮১১৭; ইবনু হিববান ৩৪৭৫; সহিহাহ্ ৫৬২; সহিহ আত্ তারগীব ১০৭২)
এ ছাড়া আধুনিককালের স্বাস্থ্যবিজ্ঞান মতে, খেজুরের ভেতর যে শক্তি ও পুষ্টিগুণ রয়েছে তা রোযাদারের জন্য অনেক বেশি শক্তিদায়ক এবং বিশেষ উপকারী। কিন্তু দুঃখের সাথে বলতে হয়, সাহরিতে খেজুর খাওয়ার এ সুন্নাতটি আমাদের মাঝে নেই।
৪. ইফতারের সময় দু’আ করা
হাদিসে বর্ণিত হয়েছে, ৩ ব্যক্তির প্রার্থনা ফিরিয়ে দেওয়া হয় না। তাদের মধ্যে একজন হলেন রোযাদার ব্যক্তি। ইফতারের পূর্ব পর্যন্ত রোযাদারের দু’আ কবুল হয়। হাদিসে এসেছে:
রোযা অবস্থায় দু’আ ফিরিয়ে দেয়া হয় না এ ব্যাপারে সহিহ হাদিস রয়েছে। নাবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
‘‘তিন ব্যক্তির দু’আ অগ্রাহ্য করা হয় না (বরং কবুল করা হয়); পিতা-মাতার দু’আ, রোযাদারের দু’আ এবং মুসাফিরের দু’আ।’’ (বাইহাকি, হাদিস নাম্বার ৩/৩৪৫; সিলসিলাহ সহিহাহ, আলবানি ১৭৯)
সুতরাং রোযাদারের জন্য ইফতারের আগ মুহূর্ত পর্যন্ত যে কোনো সময় দু’আ কবুল হওয়ার গুরুত্বপূর্ণ সময়। বিশেষ করে ইফতারের পূর্ব মুহূর্তে মানুষ ক্ষুধা-পিপাসায় কাতর ও ক্লান্ত-শ্রান্ত থাকে। তাই সে সময় দু’আ কবুলের সম্ভাবনা আরও বেশি। কারণ এ ধরণের দুর্বল ও কষ্টকর অবস্থায় দু’আ করা হলে তা কবুলের সম্ভাবনা বেশি থাকে।
সেই সাথে এ মর্মে একটি হাদিস বর্ণিত হয়েছে তা হল:
“ইফতারের সময় রোযাদারের জন্য এমন একটি দু’আ রয়েছে যা ফিরিয়ে দেয়া হয় না।”(ইবনে মাজাহ, হাকিম)
এ হাদিসটি সহিহ না কি জঈফ এ বিষয়ে মুহাদ্দিসদের মাঝে দ্বিমত রয়েছে। আল্লামা আলবানী রহ. এটিকে সনদগতভাবে জঈফ সাব্যস্ত করলেও ইমাম বূসীরী, ইবনে হাজার আসকালানী, আহমদ শাকের সহ কতিপয় মুহাদ্দিস সহিহ/হাসান হিসেবে সাব্যস্ত করেছেন।
মোটকথা, এ হাদিসটিকে জঈফ ধরে নিলেও রোযা অবস্থায় দু’আ কবুলের সহিহ হাদিস অনুযায়ী এবং ইফতারের আগে রোযাদারদের দুর্বল অবস্থায় থাকার পরিপ্রেক্ষিতে ইফতারের পূর্বে দু’আ করলে কবুল হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে ইনশাআল্লাহ। তাই রোযাদারের উচিৎ, সারা দিন রোযা অবস্থায় দু’আ করার সুযোগকে হাত ছাড়া না করা। বিশেষ করে ইফতারে আগের সময়টিকে দু’আর জন্য বেশি গুরুত্ব দেয়া।
দিনভর নানা ব্যস্ততায় আমরা দু’আয় নিমগ্ন হতে পারি না, এটাই অপ্রিয় বাস্তবতা। তাই অন্তত ইফতারপূর্ব মুহুর্তে দু’আয় মশগুল থাকা উচিত। কারণ, এটি নানা কারণে দু’আর জন্য আদর্শ সময়। সন্ধ্যার সময় দু’আ কবুল হয়, ইফতারপূর্ব মুহূর্তে দু’আর পরামর্শ দেওয়া হয়েছে এবং প্রতিদিন এ সময় জাহান্নাম থেকে বহু লোককে মুক্তির পরোয়ানা ঘোষণা করা হয়। অথচ তখন ইফতারের আয়োজনে আমরা এতটাই ব্যতিব্যস্ত থাকি যে, আজান পর্যন্ত আর নিরবে কিছু সময় আল্লাহর নিকট দু’আ ও জিকির-আজকারে মশগুল থাকার ফুরসৎ হয় না। এটা খুবই দুর্ভাগ্যজনক। বিষয়টির প্রতি সবার খেয়াল রাখা উচিত।
৫. ইফতারের সময়ও আজানের জবাব দেয়া
আজানের জবাব দেয়া বার মাসের জন্যই সুন্নাত। এ প্রসঙ্গে হাদিসে এসেছে:
আবূ সাঈদ খুদরী রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, “যখন তোমরা আযান ধ্বনি শুনবে, তখন (আযানের উত্তরে) মুআযযিন যা কিছু বলবে, তোমরাও ঠিক তাই বলো।”(সহিহ বুখারি, হাদিস নাম্বার ৬১১) আমরা জানি যে, আযানের জবাব শেষে দু’আ করলে দু’আ কবুল করা হয়। হাদিসে এসেছে:
আবদুল্লাহ ইবনু ‘আমর রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন, এক ব্যক্তি আবেদন করল, হে আল্লাহর রসূল! আযান দাতা তো আমাদের চেয়ে মর্যাদায় বেড়ে যায়। রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, তারা যেভাবে বলে তোমরাও তাদের সাথে সাথে সেভাবে বলে যাও। আর আযানের উত্তরের শেষে যা খুশী তাই আল্লাহর কাছে চাও, তোমাদেরকে দেয়া হবে। (আবূ দাঊদ, ৫২৪; সহিহ আত্ তারগীব ২৫৬)
রমযান নেক আমলের বিশেষ মাস, এ মাসের শুরুতে আল্লাহর পক্ষ থেকে নিয়োজিত আহবায়ক সৎকর্মশীল বান্দাদেরকে আমল ও ইবাদতে আরও অগ্রসর হওয়ার আহবান করে থাকেন। সুতরাং রুটিন আমলের পাশাপাশি রমযানের বিশেষ আমলগুলোর প্রতি যত্ন নেওয়া উচিত। কিন্তু আমাদের চরম দুর্ভাগ্যের বিষয় হলো, এ মাসেই বরং আমাদের অনেক গুরুত্বপূর্ণ রুটিন আমল বাদ যায়। যেমন, আজানের জবাব দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ একটি সুন্নাত। মোয়াজ্জিন আজানের সময় যেসব বাক্য উচ্চারণ করেন, তার অনুকরণে সেগুলো বলা সুন্নাত। সহিহ মুসলিমের বর্ণনায় রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, মুআজ্জিন যা বলে, তোমরাও তা বলো।’ শুধু হাইয়্যা আলাস সালাহ ও হাইয়্যা আলাল ফালাহ বলার পর ‘লা-হাওলা ওয়া লা কুওয়্যাতা ইল্লাবিল্লাহ’ বলতে হবে।
রমযানে আজানের সঙ্গে সঙ্গে আমরা ইফতারে ব্যস্ত হয়ে পড়ে আজানের জবাব দেওয়ার কথা ভুলে যাই। যা কাম্য নয়। কেননা ইফতারের সময় হচ্ছে দু‘আ কবূল হওয়ার একটি গুরুত্বপূর্ণ মূহুর্ত। হাদিসে এরশাদ হয়েছে নাবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেন,
“সিয়াম পালনকারীর ইফতারের সময়কার দু‘আ প্রত্যাখ্যান করা হয় না।”(ইবন মাজাহ, ১৭৪৩, ১৭৫৩)
তাই এ বিষয়ে আমাদের বিশেষ যত্নশীল হওয়া দরকার।
৬. রমযানের শেষ দশকের সকল বিজোড় রাতে শবে কদর অনুসন্ধান করা
রমযানের শেষ দশকের যে কোনো বিজোড় রাত কদরের রাত। এ প্রসঙ্গে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর হাদিস হলো:
‘আয়িশা রাযিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত: আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: তোমরা রমযানের শেষ দশকের বিজোড় রাতে লাইলাতুল কদরের অনুসন্ধান কর। (সহিহ বুখারি, ২০১৭)
’উকবাহ্ ইবনু হুরায়স (রহঃ) থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন, আমি ইবনু ‘উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে বলতে শুনেছি, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন: তোমরা (রমাযানের) শেষ দশ দিনে কদরের রাত অনুসন্ধান কর। তোমাদের কেউ যদি দূর্বল অথবা অপারগ হয়ে পড়ে, তবে সে যেন শেষের সাত রাতে অলসতা না করে। (সহিহ মুসলিম, ২৬৫৫)
‘আয়িশা রাযিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন, আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমযানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন এবং বলতেন: তোমরা রমযানের শেষ দশকে লাইলাতুল কদর অনুসন্ধান কর।( সহিহ বুখারি, ২০২০)
উল্লেখ্য আল্লাহ তায়ালা কুরআনুল কারিমের সূরা কদরে ঘোষণা করেছেন- লাইলাতুল কদর হাজার মাসের (ইবাদাতের) চেয়েও উত্তম। সহিহ শুদ্ধ হাদিস থেকে জানা যায় যে, লাইলাতুল কদর রমযানের শেষ দশ দিনের যে কোনো বিজোড় রাত্রিতে হয়ে থাকে। বিভিন্ন সহিহ হাদিসে ২১, ২৩, ২৫, ২৭ ও ২৯ তারিখে লাইলাতুল কদর অনুষ্ঠিত হওয়ার কথা উল্লেখিত আছে। হাদিসে এ কথাও উল্লেখিত আছে, যে কোনো একটি নির্দিষ্ট বিজোড় রাত্রিতেই তা হয় না। (অর্থাৎ কোনো বছরে ২৫ তারিখে হল, আবার কোনো বছরে ২১ তারিখে হল এভাবে। আমাদের দেশে সরকারি আর বেসরকারি ভাবে জাঁকজমকের সঙ্গে ২৭ তারিখের রাত্রিকে লাইলাতুল কদরের রাত হিসেবে পালন করা হয়। এভাবে মাত্র একটি রাত্রিকে লাইলাতুল কদর সাব্যস্ত করার কোনোই হাদিস নাই। লাইলাতুল কদরের সওয়াব পেতে চাইলে ৫টি বিজোড় রাত্রেই তালাশ করতে হবে।
বর্তমানে রাত্রি জাগরণের জন্য মসজিদে সকলে সমবেত হয়ে বিভিন্ন ওয়াজ মাহফিলের যে ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে সেটিও নবাবিষ্কৃত কাজ। কারণ আল্লাহর নাবি সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর সময়ে সাহাবিদের নিয়ে মসজিদে জাগরিত হয়ে বর্তমানে প্রচলিত পদ্ধতিতে ইবাদত না করে নিজ নিজ পরিবারকে জাগিয়ে কিয়ামুল লাইল পালন করতেন।
৭. বিশ রমযানের পর হতে ইবাদতে বেশি মনোযোগী হওয়া
রমযান পুরোটাই মুবারকময়। বিশেষ করে শেষ দশক। হাদিসে এসেছে:
‘আয়িশা রাযিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন, যখন রমযানের শেষ দশক আসত তখন নাবি সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম তাঁর লুঙ্গি কষে নিতেন (বেশি বেশি ইবাদতের প্রস্তুতি নিতেন) এবং রাত্র জেগে থাকতেন ও পরিবার-পরিজনকে জাগিয়ে দিতেন।(সহিহ বুখারি, ২০২৪)
আর আমরা ২০ রমযানের পর ঈদ কেন্দ্রিক ব্যস্ততা বাড়িয়ে দেই, ইবাদত বন্দেগি কমিয়ে দেই। দুঃখের সাথে বলতে হয়, রমযানের শেষের দিকে কেউ কেউ তারাবি নামাযও পড়ার সময় পান না।
৮. ইতিকাফ করা
আয়িশা রাযিয়াল্লাহু আনহা বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম আমৃত্যু প্রতি বছর রমযানের শেষ দশকে ইতিকাফ করতেন।
আয়িশা রাযিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত: নাবি সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম রমযানের শেষ দশক ইতিকাফ করতেন। তার ওফাত পর্যন্ত এই নিয়মই ছিল। এরপর তার সহধর্মিণীগণও (সে দিনগুলোতে) ইতিকাফ করতেন।(সহিহ বুখারি, ২০২৬; মুসলিম ১১৭২)
ইতিকাফকে তিনি খুবই গুরুত্ব দিতেন। যেমন:
আনাস ইবনু মালিক রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন, রমযানের শেষ দশদিন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইতিকাফ করতেন। কিন্তু তিনি এক বছর ইতিকাফ করতে সক্ষম হননি। তাই তিনি পরের বছর বিশ দিন ইতিকাফ করেন। (তিরমিজি, ৮০৩; আবূ দাঊদ ২১২৬)
এখন তো আমাদের সমাজের সবচেয়ে অবহেলিত আমলে পরিণত হয়েছে ইতিকাফ। শবে কদর প্রাপ্তি ও শেষ দশকের ইবাদতে পরিপূর্ণভাবে মশগুল থাকার আশায় যেখানে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম জীবনের প্রতিটি বছর ইতিকাফ করতেন, সেখানে আমরা বেশিরভাগ লোক জীবনে এই আমলটি একবারও করতে পারি না। কোনো কোনো মসজিদে লোক ভাড়া করে এনে মসজিদ কমিটি ইতিকাফ করান বটে, তবে উনারা ইতিকাফ করেন না। তাতে মনে হয় ইতিকাফ বুঝি উনাদের আমল করার নয়। সমাজের যারা বেকার, গরিব তারাই এ আমল করবে। তাদের মনে রাখা দরকার যে রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ছিলেন মদিনার রাষ্ট্রপতি, তার পরেও তিনি ইতিকাফ করেছেন। রাষ্টপতির চেয়েও কি আপনি বেশি ব্যস্ত? রমযানের বিশেষত্ব হলো, এ মাসে শবে কদর রয়েছে। কোনো ব্যক্তি যদি ইতিকাফ করেন, তার দ্বারা শবে কদর লাভ করার সৌভাগ্য অর্জনে বিশেষ সহায়ক হয়। সত্যিই ইতিকাফ একটা বিরাট ফজিলতপূর্ণ আমল!
৯. বিশ দিনের ইতিকাফ করা
পূর্বেই আলোচনা হয়েছে যে ১০ দিনের ইতিকাফই আমাদের সমাজে প্রায় অচল। সে হিসেবে ২০ দিনের ইতিকাফ তো আমাদের সমাজে আরও সুদূরপরাহত। অথচ রাসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম এর আমল ছিল:
আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন, নাবি সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম প্রতি রমযানে দশ দিনের ইতিকাফ করতেন। যে বছর তিনি ইন্তিকাল করেন সে বছর তিনি বিশ দিনের ইতিকাফ করেছিলেন।( সহিহ বুখারি, ২০৪৪)
১০. মসজিদে মহিলাদের ইতিকাফ করা
‘আয়িশাহ্ রাযিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত: নাবি সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইন্তিকালের পূর্ব পর্যন্ত রমাযানের শেষ দশকেই ই‘তিকাফ করতেন। তাঁর ইন্তিকালের পর তাঁর সমধর্মিনীগণও ই‘তিকাফ করতেন।(সহিহ বুখারি, ২০২৬; মুসলিম ১০৭২)
বর্তমান আমাদের সমাজে মসজিদে মহিলাদের ইতিকাফের আমলটি চালু তো নেইই। বরং তা আলোচনাতেও নেই। এ বিষয়টি কেউ বলতে গেলে বলা হবে, “এগুলো নতুন হাদিস!”
১১. রোযা অবস্থায় দাওয়াত কবুল করা
দাওয়াত কবুল করা রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুন্নাহ। হাদিসে এসেছে:
আবূ হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন, আল্লাহর রসূল সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে আমি বলতে শুনেছি যে, এক মুসলিমের প্রতি অপর মুসলিমের হক পাঁচটি:
১. সালামের জবাব দেয়া,
২. অসুস্থ ব্যক্তির খোঁজ-খবর নেয়া,
৩. জানাযার পশ্চাদানুসরণ করা,
৪. দা'ওয়াত কবূল করা এবং
৫. হাঁচিদাতাকে খুশী করা অর্থাৎ আল-হামদুলিল্লাহর জবাবে ইয়ারহামুকাল্লাহ বলা। (সহিহ বুখারি, ১২৪০)
তাই রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম রোযা অবস্থায় থাকলেও বিবাহ ও অন্যান্য দাওয়াতে উপস্থিত হতেন। এ বিষয়ে হাদিস:
‘আব্দুল্লাহ্ ইবনু ‘উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন যে, নাবি সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, যদি তোমাদেরকে বিয়ের অনুষ্ঠানে দাওয়াত দেয়া হয়, তবে তা রক্ষা কর। নাফি’ বলেন, ‘আবদুল্লাহ ইবনু ‘উমার রাযিয়াল্লাহু আনহু - এর নিয়ম ছিল, তিনি রোযা থাকা অবস্থাতেও বিয়ের বা অন্য কোনো দাওয়াত রক্ষা করতেন। (সহিহ বুখারি, ৫১৭৯)
উল্লেখ্য যে, অলীমার জন্য আমন্ত্রিত হলে উপস্থিত হওয়া জরুরি। এমন কি রোযা রেখে থাকলেও উপস্থিত হয়ে তাদের জন্য দু’আ করতে হবে। এ প্রসঙ্গে হাদিসে এসেছে:
১. ইবন উমার রাযিয়াল্লাহু আনহুমা থেকে বর্ণিত, নাবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম কে কেউ দাওয়াত দিলে তিনি সেখানে যেতেন। সাওম পালনকারী হলে সেখানে গিয়ে বরকতের দু’আ করে ফিরে আসতেন আর সাওম পালনকারী না হলে বসতেন এবং খেতেন। (ইবন হিব্বান, ৫২৯০)
আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,
২. “যখন তোমাদের কাউকে দাওয়াত দেওয়া হয় সে যেন তাতে সাড়া দেয়। যদি সে সাওম পালনকারী হয় তাহলে সে (ওখানে গিয়ে) দু’আ ও সালাতরত থাকবে। আর যদি সাওম পালনকারী না হয় তাহলে সে আহার করবে।”(সহিহ মুসলিম, ১৪৩১)
বিশেষ করে দাওয়াতদাতার মন ভাঙ্গার ভয় থাকলে নাফল রোযা ভেঙ্গে খাওয়াই উত্তম। এ ব্যাপারে রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম -এর নির্দেশ নিম্নরূপ
আবূ সাঈদ খুদরী রাযিয়াল্লাহু আনহু বলেন, একদা আমি আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম-এর জন্য খাবার তৈরি করলাম। তিনি তাঁর অন্যান্য সহচর সহ আমার বাড়িতে এলেন। অতঃপর যখন খাবার সামনে রাখা হল, তখন দলের মধ্যে একজন বলল, ‘আমি রোযা আছি।’ তা শুনে আল্লাহর রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বললেন, ‘‘তোমাদের ভাই তোমাদেরকে দাওয়াত দিয়ে খরচ (বা কষ্ট) করেছে।’’ অতঃপর তিনি তার উদ্দেশ্যে বললেন, ‘‘রোযা ভেঙ্গে দাও। আর চাইলে তার বিনিময়ে অন্য একদিন রোযা রাখ।’’(তাবারানী, ইরওয়াউল গালীল ১৯৫২)
অথচ আমাদের দেশে রোযাদারকে কেউ রোযা(নাফল রোযা) অবস্থায় খাবারের দাওয়াত দিলে সঙ্গে সঙ্গে উনি বলে ফেলেন যে, তিনি রোযা আছেন তাই দাওয়াতে যেতে পারবেন না। অথচ এ কথাটি রাসূল সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এর সুন্নাহ পরিপন্থী কাজ।
১২. প্রতি সোম ও বৃহস্পতিবার রোযা রাখা
আয়িশা রাযিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন, নাবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম সোম ও বৃহস্পতিবারের রোযার প্রতি খুবই খেয়াল রাখতেন।(শামায়েলে তিরমিযি, ২৩০; সুনানে নাসাঈ ২৩৬১)
রমযানের ফরজ রোযা ছাড়াও রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বিভিন্ন উপলক্ষ্যে বিশেষ বিশেষ দিনে রোযা রেখেছেন এবং তাঁর উম্মতকে রোযা রাখতে বলেছেন। তন্মদ্ধে উল্লেখযোগ্য দিন হলো: প্রতি সপ্তাহে ২দিন সোম ও বৃহস্পতিবারের রোযা। এ রোযা পালন প্রসঙ্গে হাদিসে এসেছে-
প্রিয় নাবি সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম এ দু’দিন রোযা রাখার গুরুত্ব বর্ণনা করে ঘোষণা করেন-
১. আবূ হুরাইরা রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন,“(মানুষের) আমলসমূহ সোম ও বৃহস্পতিবারে (আল্লাহর দরবারে) পেশ করা হয়। তাই আমি ভালবাসি যে, আমার আমল এমন অবস্থায় পেশ করা হোক, যখন আমি সিয়ামের অবস্থায় থাকি।”( সহিহ মুসলিম, ২৫৬৫; তিরমিযি ৭৪৭, ২০২৩)
২. জুবায়র ইব্ন নূফায়র থেকে বর্ণিত: এক ব্যক্তি আয়েশা রাযিয়াল্লাহু আনহু-কে সাওম (রোযা) সম্পর্কে জিজ্ঞাসা করলে তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম পূর্ণ শা’বান মাস সাওম (রোযা) পালন করতেন আর সোমবার এবং বৃহস্পতিবারের সাওম (রোযা) উত্তম মনে করতেন। (সুনানে নাসাঈ, ২১৮৬)
৩. আয়িশা রাযিয়াল্লাহু আনহা থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন যে, রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম শা’বান এবং রমযান মাসে সাওম (রোযা) পালন করতেন আর সোমবার এবং বৃহষ্পতিবারের সাওমকে (রোযাকে)উত্তম মনে করতেন। (সুনানে নাসাঈ, ২১৮৭)
রোযা যেহেতু আল্লাহ তাআলার নৈকট্য অর্জনের অন্যতম মাধ্যম। তাই ফরজ রোযা ছাড়াও প্রিয় নাবি ঘোষিত বিশেষ বিশেষ দিনে রোযা পালন করার মাধ্যমে আল্লাহর নৈকট্য অর্জনে এগিয়ে আসা জরুরি।
আর সোম ও বৃহস্পতিবার যেহেতু বান্দার আমল আল্লাহর কাছে পৌছানো হয়; তাই সপ্তাহে এ দুইদিন প্রিয় নাবির অনুসরণে রোযা পালনেও আল্লাহর কাছে সুন্দর বিনিময় পাওয়া সম্ভব। আল্লাহ তাআলা আমাদিগকে যেন প্রতি সপ্তাহে সোম ও বৃহস্পতিবার রোযা রাখার তাওফিক দান করুন। আমিন।
১৩. প্রতি মাসে তিন দিন রোযা রাখা
সোম ও বৃহস্পতিবার ছাড়াও প্রতি মাসে তিন দিন রোযা রাখা একটি উত্তম আমল। কিন্তু এর আমলকারির সংখ্যা খুবই নগন্য। এর গুরুত্ব সম্পর্কে হাদিসে এসেছে:
১. উসমান ইব্ন আবুল আস রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত: আমি রাসূলুল্লাহ্ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম-কে বলতে শুনেছি: উত্তম সাওম (রোযা) হল প্রতি মাসে তিন দিন সওম পালন করা। ( সুনানে নাসাঈ, ২৪১১)
২. ‘‘আব্দুল্লাহ ইবনু ‘আমার ইবনুল ‘আস রাযিয়াল্লাহু আনহু থেকে বর্ণিত: রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম আমার সাথে সাক্ষাত করে বললেন, আমাকে কি জানানো হয়নি যে, তুমি বলেছো, আল্লাহর শপথ! আমি সারা দিন সওম রাখবো এবং সারা রাত দাঁড়িয়ে সালাত পড়বো? তিনি বললেন হ্যাঁ, হে আল্লাহর রাসূল! আমি এরূপ বলেছি। তিনি বললেন, সালাত আদায় করবে এবং নিদ্রায়ও যাবে। সওম পালন করবে এবং কোনো দিন সওম থেকে বিরত থাকবে। তুমি প্রতি মাসে (১৩, ১৪, ও ১৫ তারিখ) তিনটি সওম রাখো, এটাই সারা বছর সওম পালনের সমতুল্য। আমি বললাম, হে আল্লাহর রাসূল! আমি এর চেয়ে অধিক শক্তি রাখি। তিনি বললেন, তাহলে একদিন সওম রাখো এবং একদিন সওম থেকে বিরত থেকো। এটিই সর্বোত্তম সওম এবং এটিই হচ্ছে দাঊদ ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম -এর সওম। আমি বললাম, আমি এর চাইতেও অধিক শক্তি রাখি। তখন রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম বললেন, এর চেয়ে উত্তম সওম নেই। (আবু দাউদ, ২৪২৭)
১৪. রোযা হতে শিক্ষা গ্রহণ না করা
রোযা গুরুত্বপূর্ণ একটি মৌলিক ইবাদাত। আমাদের জীবনে রোযার গুরুত্ব ও তাৎপর্য অপরিসীম। অন্যান্য ইবাদতের ন্যায় রোযার মধ্যে আমাদের জন্য শিক্ষণীয় অনেক বিষয় রয়েছে। আমাদের জীবনকে সুন্দরভাবে সাজাতে হলে এসব শিক্ষা গ্রহণ করা অত্যন্ত জরুরি। রোযা তথা যে কোনো ইবাদত হতে যদি কোনা শিক্ষনীয় কিছু নাই থাকে তা হলে তা লক্ষ্যহীন। আর লক্ষ্যহীন কোনো ইবাদত আল্লাহ তায়ালা তার বান্দার জন্য নিশ্চয়ই নির্দ্ধারণ করবেন না, এটাই স্বভাবিক। আমরা জানি রোযা একটি কষ্টসাধ্য ইবাদত। অহেতেুক আল্লাহ বান্দাকে কষ্ট দেবেন তা হয় না। সেহেতু রোযা হতে কিছু শিক্ষনীয় বিষয় অবশ্যই থাকবে। নিম্নে রোযার গুরুত্বপূর্ণ কয়েকটি শিক্ষা সংক্ষেপে আলোচনা করা হলো:
এক. হারাম থেকে দুরে থাকা
রোযার দিনে শতভাগ হালাল ও পবিত্র খাদ্য গ্রহণ কে আমরা একশতভাগ হারাম মনে করি। ভুলে মুখে নিলেও স্বরণে আসার সঙ্গে সঙ্গে আমরা তা ফেলে দেই। নিজের বিবাহিত/বিবাহিতা স্বামী-স্ত্রীর একান্ত মুহূর্তের সম্পর্ককে আমরা পরস্পরে পরপুরুষ কিংবা পরস্ত্রীর মতো হারাম মনে করি।
রমজানের দিনের বেলায় আল্লাহ তায়ালা একটি মাস ধরে হালাল খাদ্যকে হারাম এবং হালাল স্ত্রীকে হারাম করে দিয়ে তা মানার বাধ্যবাধকতামূলক অনুশীলনের ব্যবস্থা করেছেন। এটি আমরা অক্ষরে অক্ষরে পালন করি বটে; কিন্তু এর উদ্দেশ্য কী তা আমরা অনেকেই বুঝতে চেষ্টা করি না। এতে কী লাভ? তাও অনেকেই হৃদয়ঙ্গম করতে ব্যর্থ।
এর উদ্দেশ্য হলো: মানুষ যদি একটি মাস ধরে এভাবে হালালকেও হারাম মনে করে তাকে পরিহার করতে অভ্যস্ত হয়, তাহলে সে বছরের পরবর্তী এগারটি মাস অন্ততঃ হারামকে অবশ্যই হারাম হিসেবে বর্জন করতে পারবে। মহান আল্লাহ কর্তৃক ঘোষিত কোনো নিষিদ্ধ কর্মকাণ্ড তার দ্বারা সংঘটিত হবে না। পরস্ত্রী ও হারাম সম্পদের প্রতি সে ঘুণাক্ষরেও তাকাবে না। কিন্তু, তা কি আমরা অর্জন করতে পেরেছি? পারিনি এ কারণেই যে, আমরা তো উদ্দেশ্যহীন গন্তব্যের পথিক। না খেয়ে রোযা পালন করার কথা, তাই করলাম। কেন যে করলাম তা বুঝলাম না। এভাবেই কাটিয়ে দিলাম সারাটি জীবন। আমাদের রোযা আসলেই কি পরিপূর্ণ হলো?
রাসুল (সল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়া সাল্লাম)বলেছেন:
খাওয়া ও পান করা থেকে বিরত থাকার নাম রোযা নয়; বস্তুতঃ রোযা হল: অনর্থক ও অশ্লীল কাজ হতে বিরত থাকা।
দুই. তাকওয়া অর্জন
রোযার সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ শিক্ষা হচ্ছে তাকওয়া বা আল্লাহভীতি অর্জন করা। তাকওয়া অর্জনই রোযার মূল উদ্দেশ্য। এ সম্পর্কে আল্লাহ তায়ালা ইরশাদ করেছেন, হে ঈমানদারগণ! তোমাদের ওপর রোযা ফরয করা হয়েছে যেমন তোমাদের পূর্ববর্তীদের ওপর ফরয করা হয়েছিল যেন তোমরা তাকওয়া অর্জন করতে পারো।“ (সুরা বাকারা, আয়াত ১৮৩) কেউ যদি রোযা রেখেও তাকওয়া অর্জন করতে না পারে অর্থাৎ রোযা রেখেও গোনাহের কাজ ছাড়তে না পারে তাহলে তার রোযার উদ্দেশ্য পূরণ হবে না। এরূপ রোযা আল্লাহ তায়ালার কাছে গ্রহণযোগ্য নয়। এ সম্পর্কে হযরত আবু হুরায়রা রা. হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি পাপ, মিথ্যা বা অন্যায় কথা, অন্যায় কর্ম এবং মূর্খতাসুলভ কর্ম ত্যাগ করতে না পারবে তার পানাহার ত্যাগ করাতে আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই। (বুখারি, ১৯০৩, ৬০৫৭)
তিন. সহানুভূতি
যারা সারা বছর পেট পুরে পানাহার করেন তারা ক্ষুধার্ত মানুষের কষ্টে কথা অনুধাবন করার কথা নয়। মহান আল্লাহ একটি মাস রোযা রাখার বিধান করে এ বিষয়টি হাতে কলমে শিক্ষা দিলেন। যাতে বিত্তশালীগণ অসহায় গরীব ক্ষুধার্ত মানুষদের ক্ষুধার কষ্ট বুঝতে পারে। ফলে তাদের প্রতি সহানুভূতি সৃষ্টি হবে। বিত্তশালীরা এখানকার এ শিক্ষা নিয়ে সারা বছর কাজে লাগাবে অসহায় মানুষের তরে। এ জন্য এ মাসের আরেক নাম সহানুভূতির মাস। এ সম্পর্কে হযরত সালমান রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত একটি দীর্ঘ হাদীসের একাংশে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘ইহা মানুষের প্রতি সহানুভুতি প্রদর্শনের মাস। যে ব্যক্তি এই মাসে আপন গোলাম (কর্মচারী ও খাদেম) এর কাজের বোঝা হালকা করে দেয়, আল্লাহ তায়ালা তাকে মাফ করে দেন এবং জাহান্নামের আগুন হতে মুক্তি দান করেন।’ (ইবনে খুজাইমা,বায়হাকি,ইবনে হিব্বান)
বাস্তব সত্য হলো; সহানুভূতি প্রদর্শনের এ শিক্ষা সারা বছর আমাদের মাঝে অনুপস্থিত।
চার. ইখলাস
নামায, হজ্জ, যাকাত, জিহাদ ইবাদাতে রিয়া বা লোক দেখানো মনোভাবের সম্ভাবনা থাকে। নামায, হজ্জ, জিহাদ গোপনে করা যায় না। কেউ না কেউ তা দেখে, সেহেতু এতে রিয়া বা লৗকিকতার সুযোগ থাকে। কিন্তু রোযার মধ্যে রিয়া বা লোক দেখানোর কোনো সম্ভাবনা নেই। যিনি রোযা রেখেছেন তিনিই তার সাক্ষী। রোযাদার ইচ্ছা করলে ঘরের কোনায় চুপিসারে পানাহার করতে পারেন, কিন্তু তা তিনি করেন না। তিনি রোযা আছেন কি না, তা তিনিই জানেন, অন্য মানুষের জানার কথা নয়। রোযা একমাত্র আল্লাহ তায়ালার উদ্দেশ্যেই করা হয়। এজন্য রোযার প্রতিদান আল্লাহ তায়ালা নিজ হাতে দিতে চেয়েছেন। এ ব্যাপারে হযরত আবু হুরায়রা রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, “আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘আদম সন্তানের প্রত্যেক আমলের সওয়াব দশগুণ থেকে সাতশক গুণ বৃদ্ধি করা হয়। একমাত্র ব্যতিক্রম হলে রোযা। রোযা আমার জন্য। আর রোযার প্রতিদান আমি নিজেই দেব। কেননা রোযাদার একমাত্র আমার সন্তুষ্টির জন্যই তার কামনাবাসনা ও পানাহার থেকে বিরত থাকে। (বুখারি ১৮৯৪)
তাই রোযা পালনের মাধ্যমে একনিষ্ঠতা অর্জনের কথা, যা আমরা অন্যান্য ইবাদতের বেলায় প্রয়োগ করতে পারি। কিন্তু দুঃখের বিষয়, এ শিক্ষা আমরা গ্রহণ করতে প্রায় ব্যর্থ হয়েছি।
পাঁচ. সবর বা ধৈর্য
রোযা পালনের মাধ্যমে দুঃখ-কষ্টে সবর করার শিক্ষা রয়েছে। মুমিনগণ রমজানে দীর্ঘ একমাস রোযা রেখে আল্লাহ তায়ালার সন্তুষ্টির জন্য ক্ষুধা-পিপাসা ও নফসের খাহেশাত দমন করার কষ্ট তারা অম্লান বদনে সহ্য করে নেয়। তাই রমজানকে সবর বা ধৈর্যের মাস বলা হয়। এ সম্পর্কে সালমান রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত একটি দীর্ঘ হাদীসের একাংশে রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেছেন, ‘ইহা সবরের মাস। আর সবরের প্রতিদান জান্নাত।’ (ইবনে খুজাইমা,বায়হাকি,ইবনে হিব্বান) এ একটি মাস সবর এর ট্রেনিং নিয়ে সারা বছর কাজে লাগাতে হবে এটাই এটাই কাম্য। কিন্তু তা গ্রহণ করা থেকে আমরা অনেক দুরে। এ আমল রোযার পরই বেমালুম ভুলে যাই।
ছয়. কুপ্রবৃত্তি দমন
রোযা কুপ্রবৃত্তি দমনের শ্রেষ্ঠ হাতিয়ার। রোযার দ্বারা কুপ্রবৃত্তি অনেক দুর্বল হয়ে পড়ে। ফলে পাপের কাজে তেমন আগ্রহ থাকে না। বরং নেক কাজে উৎসাহ বাড়ে। তাই রোযাকে খারাপ কাজ থেকে বাঁচার ঢাল বলা হয়েছে। আবু হুরায়রা (রা) হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম বলেছেন, ‘আল্লাহ তায়ালা বলেন, ‘রোযা ঢালস্বরূপ।‘(বুখারি ১৯০৪) রমজানের রোযা পালনের মাধ্যমে যে ঢাল তৈরি হবে তা দিয়ে সারা বছর শয়তানের বিরুদ্ধে যুদ্ধ করার কথা। কিন্তু কৈ তা তো দেখা যায় না।
সাত. ভ্রাতৃত্ব
রোযার মাধ্যমে মু’মিনদের মাঝে ভ্রাতৃত্বের বন্ধন মজবুত করার শিক্ষা দেয়া হয়। রোযার মাসে মু’মিনগণ সওয়াবের আশায় একে অপরকে ইফতার করায়। এছাড়া রমজানে বিশেষ গুরুত্ব সহকারে পাঁচওয়াক্ত নামায ও তারাবীহ নামায পরস্পর পরস্পরের কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে জামাতে নামায আদায় করে। তখন সব মুসলমান একে অপরের ভাইয়ের মত হয়ে যায়। আল্লাহ তায়ালা বলেছেন, “নিশ্চয় মুমিনগণ ভাই ভাই।“(সুরা হুজুরাত, আয়াত ১০) রোযার পরেও এ ভ্রাতৃত্বের বন্ধন অটুট থাকবে এটাই রোযার উদ্দেশ্য। কিন্তু তা আমরা রোযা পর্যন্তই পালন করি, পরে নয়।
আট. ঐক্য
সকল মুসলমান একই সময়ে অর্থাৎ রমজান মাসে একই নিয়মে অর্থাৎ সুবহে সাদিক হতে সূর্যাস্ত পর্যন্ত পানাহার ও কামাচার হতে বিরত থেকে সম্মিলিতভাবে অর্থাৎ রাজা-প্রজা, ধনী-গরীব, ফর্সা-কালো, নারী-পুরুষ সকলেই একসঙ্গে আল্লাহর হুকুম রোযা পালন করে। এতে বিরাট ঐক্যের চিত্র ফুটে ওঠে। আর আল্লাহর হুকুম সম্মিলিতভাবে ঐক্যবদ্ধভাবে পালনের নির্দেশ দিয়ে আল্লাহ তায়ালা পবিত্র কুরআনে বলেছেন, “তোমরা ঐক্যবদ্ধভাবে আল্লাহর রজ্জুকে আকড়ে ধরো এবং পরস্পর বিচ্ছিন্ন হয়ো না।” (সুরা আলে ইমরান, আয়াত ১০৩) রমযানে ঐক্যের যে চিত্র মুসলমানের মধ্যে পরিলক্ষিত হয়, রোযার পরেই তার অবসান ঘটে। রমযানের পরে মুসলমানদের দেখলে মনে হয় না যে তারা কখনও ঐক্যের বন্ধনে আবদ্ধ ছিল। অথচ এটি অস্তিত্ব রক্ষার অন্যতম হাতিয়ার। হাদিসে এসেছে:
আবু হুরাইরা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম বলেছেন, ‘‘মহান আল্লাহ তোমাদের জন্য তিনটি জিনিস পছন্দ করেন এবং তিনটি জিনিস অপছন্দ করেন। তিনি তোমাদের জন্য পছন্দ করেন যে, তোমরা তাঁর ইবাদত কর, তার সঙ্গে কোন কিছুকে অংশী স্থাপন করো না এবং আল্লাহর রজ্জুকে জামাআতবদ্ধভাবে আঁকড়ে ধর এবং দলে দলে বিভক্ত হয়ো না। আর তিনি তোমাদের জন্য যা অপছন্দ করেন তা হল, অহেতুক আলোচনা-সমালোচনায় লিপ্ত হওয়া, অধিকাধিক প্রশ্ন করা এবং ধন-সম্পদ বিনষ্ট করা।’’ (মুসলিম ১৭১৫; আহমাদ ৮১৩৪, ৮৫০১, ৮৫৮১, মুওয়াত্তা মালিক ১৮৬৩)
ইবনু উমার (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন, ‘জাবিয়া’ (সিরিয়ার অন্তর্গত) নামক জায়গায় উমার (রাযিয়াল্লাহু আনহু) আমাদের সামনে খুতবাহ দেয়ার উদ্দেশ্যে দাঁড়িয়ে বলেন: হে উপস্থিত জনতা! ...তোমরা ঐক্যবদ্ধ হয়ে বসবাস কর। বিচ্ছিন্নতা হতে সাবধান থেকো। কেননা, শাইতান বিচ্ছিন্নজনের সাথে থাকে এবং সে দুজন হতে অনেক দুরে অবস্থান করে। যে লোক জান্নাতের মধ্যে সবচাইতে উত্তম জায়াগার ইচ্ছা পোষণ করে সে যেন ঐক্যবদ্ধ হয়ে থাকে (মুসলিম সমাজে)। যার সৎ আমল তাকে আনন্দিত করে এবং বদ্ আমল কষ্ট দেয় সেই হলো প্রকৃত ঈমানদার। (সহিহ ইবনু মাজাহ ২৩৬৩)
উমর ইবনুল খাত্তাব (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, হজরত রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘যে ব্যক্তি জান্নাতের সর্বোত্তম অংশে বসবাস করে আনন্দিত হতে চায়, সে যেন ঐক্যবদ্ধভাবে আল্লাহর রজ্জুকে আঁকড়ে ধরে। ’ (তিরমিজি)
রাসুলে আকরাম (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) ইরশাদ করেন, ‘তোমরা ঐক্যবদ্ধভাবে জীবন-যাপন কর, সংঘবদ্ধ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে জীবন-যাপন করো না, কারণ বিচ্ছিন্ন জীবন-যাপন করলে শয়তানের কু-প্ররোচনায় আকৃষ্ট হয়ে পথভ্রষ্ট হয়ে যাবে। ’ (আবু দাউদ ও ইবনে মাজা)
ইবনে উমর (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত, রাসুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম) বলেন, ‘যে ব্যক্তি সংঘবদ্ধ থেকে বিচ্ছিন্ন অবস্থায় মৃত্যুবরণ করবে তার মৃত্যু হবে জাহিলিয়াতের মৃত্যু।’ (মুসলিম) দূঃখের বিষয় মুসলমানদের বর্তমানে বিপর্যয়ের বড় কারণ হলো অনৈক্য। কিন্তু আমরা তো রমযান থেকে ঐক্যের শিক্ষা নিচ্ছি না।
নয়. সম্প্রীতি
রোযা মানুষের মাঝে বিদ্যমান ঝগড়া বিবাদ ও মারামারি-হানাহানি থেকে বিরত থাকার শিক্ষা দেয়। এভাবে পরস্পরের মাঝে সম্প্রীতি ও ভালোবাসা প্রতিষ্ঠার প্রতি উৎসাহ যোগায়। এ ব্যাপারে আবু হুরাইরা রাযিয়াল্লাহু আনহু হতে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম ইরশাদ করেন, আবু হুরাইরা (রাযিয়াল্লাহু আনহু) থেকে বর্ণিত: তিনি বলেন, রাসূলুল্লাহ (সাল্লাল্লাহু ‘আলাইহি ওয়া সাল্লাম) বলেছেন, “যখন তোমাদের কারো রোযার দিন হবে, সে যেন অশ্লীল ভাষা প্রয়োগ না করে ও হৈ-হট্টগোল না করে। আর যদি কেউ গালাগালি করে অথবা তার সাথে লড়াই ঝগড়া করে, তাহলে সে যেন বলে যে, ‘আমি রোযাদার।” (সহিহ বুখারি ১৮৯৪, ১৯০৪, মুসলিম ১১৫১)
দশ. মানুষকে আহার করানো
হাদিসে আছে, ‘রোযাদারকে ইফতার করালে রোযাদারের সমপরিমাণ সাওয়াব অর্জন করবে’ (মুসনাদে আহমদ, ১৭০৭৪) নবীজি মানুষকে আহার করানোর জন্য এভাবে উদ্বুদ্ধ করেছেন। মন ভরে ইফতার বিলাতে হবে। রোযাদারকে ইফতার করানোর মধ্য দিয়ে মানুষকে আহার করানোর একটি মানসিকতা তৈরি করতে হবে। পরিচিত-অপরিচিত সবার প্রতি সমান ভালোবাসা নিয়ে ইফতার বিলাতে হবে। অপরের পাশে দাঁড়ানোর এই মূল্যবান মানসিকতার মধ্য দিয়ে আভিজাত্যের একটা চর্চা নিজেদের জীবনে সৃষ্টি করতে হবে। বছরের বাকি দিনগুলোতেও সৃষ্টির প্রতি যথাযথ বদান্যতা প্রদর্শন করতে হবে। এগুলোই রমজান শিখিয়ে যায়। কিন্তু রমযান শেষ হলে আমরা কি তা মনে রাখি?
এগারো. সুন্দর আচরণ
মানুষের সঙ্গে সুন্দর আচরণ করা একটি ইবাদত। হাদিসে বলা হয়েছে, ‘তোমাদের মাঝে সর্বোত্তম সে যার আচরণ ভালো, যার চরিত্র সুন্দর’। রমজান মাসে মানুষের প্রতি সুন্দর আচরণের মাত্রা আরো বাড়িয়ে দেয়ার পরিবেশ সৃষ্টি হয়। নবীজি বলেছেন, ‘যদি তোমাকে কেউ গালি দেয় কিংবা তোমার সঙ্গে ঝগড়া করে তাহলে তুমি বল যে আমি রোযাদার’ (সহিহ বুখারি, ১৮৯৪)। এর মানে হলো তুমি তার মত কটু কথা বলো না। নিজেকে কটুভাষী হিসেবে উপস্থাপিত করো না। সংযত হয়ে বলো আমি রোযাদার। অনাকাঙ্খিত একটি আচরণের বিনিময়ে তুমি কাঙ্খিত সুন্দর আচরণ প্রদর্শন করো। তার মানে-কেউ খারাপ আচরন করলেও তার জবাব ভাল দিয়েই দিতে হবে, এটাই রোযার শিক্ষা। যা সারা বছর জারি রাখতে হবে।
লেখক: একজন কলেজ শিক্ষক; সভাপতি, বাংলাদেশ সাহিত্য ছাউনি)