রবিবার, ০৭ ডিসেম্বর ২০২৫
শিরোনাম :
  • তাইরান লেখক সম্মাননা-২০২৫ পাচ্ছেন যারা তাইরান লেখক সম্মাননা-২০২৫ পাচ্ছেন যারা দিনব্যাপী ছোটদের সময়–যুগপূর্তি শিশুসাহিত্য উৎসব ২০২৫, রেজিস্ট্রেশন চলছে দিনব্যাপী ছোটদের সময়–যুগপূর্তি শিশুসাহিত্য উৎসব ২০২৫, রেজিস্ট্রেশন চলছে শান্তির ছায়া প্রোডাকশন হাউজ প্রকাশ করল ইতিহাসভিত্তিক কার্টুন “শাহজালাল” শান্তির ছায়া প্রোডাকশন হাউজ প্রকাশ করল ইতিহাসভিত্তিক কার্টুন “শাহজালাল” সীরাত স্মারকের মোড়ক উন্মোচন ও লেখক সম্মেলন অনুষ্ঠিত সীরাত স্মারকের মোড়ক উন্মোচন ও লেখক সম্মেলন অনুষ্ঠিত রংপুরে দেশীয়'র সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত রংপুরে দেশীয়'র সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত বগুড়া কালচারাল একাডেমির উদ্যোগে দিনব্যাপী সাংস্কৃতিক কর্মশালা অনুষ্ঠিত বগুড়া কালচারাল একাডেমির উদ্যোগে দিনব্যাপী সাংস্কৃতিক কর্মশালা অনুষ্ঠিত কিডস ক্রিয়েশন টিভির আবৃত্তি, উপস্থাপনা ও সংবাদপাঠ কর্মশালা-এর সমাপনী অনুষ্ঠিত কিডস ক্রিয়েশন টিভির আবৃত্তি, উপস্থাপনা ও সংবাদপাঠ কর্মশালা-এর সমাপনী অনুষ্ঠিত শিল্পী ইউসুফ বকুল ও আবদুল ওয়াদুদের  আম্মার ইন্তেকালে দেশীয়’র শোক শিল্পী ইউসুফ বকুল ও আবদুল ওয়াদুদের আম্মার ইন্তেকালে দেশীয়’র শোক বগুড়ায় সিরাতুন্নবী (সাঃ) উপলক্ষে সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত বগুড়ায় সিরাতুন্নবী (সাঃ) উপলক্ষে সাংস্কৃতিক প্রতিযোগিতা অনুষ্ঠিত বগুড়া সাংস্কৃতিক পরিষদের কাওয়ালী সন্ধ্যা অনুষ্ঠিত বগুড়া সাংস্কৃতিক পরিষদের কাওয়ালী সন্ধ্যা অনুষ্ঠিত
  • জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সাহিত্য-সাংস্কৃতিক প্ল্যাটফর্ম: ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক অবদান

    ড. মাহফুজুর রহমান আখন্দ

    ২ ডিসেম্বর, ২০২৫ ১৭:০৩ পি এম

    জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সাহিত্য-সাংস্কৃতিক প্ল্যাটফর্ম: ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক অবদান

    কোটা সংস্কার আন্দোলনের মাধ্যমেই চব্বিশের জুলাই গণঅভ্যুত্থানের সূচনা হয়। তবে এই আন্দোলন নিছক কোটার দাবির আন্দোলন ছিলো না—বরং এটি ছিলো প্রজন্মের আর্তনাদ, প্রতিরোধ ও পুনর্জাগরণের প্রতিচ্ছবি; তরুণদের সচেতন ও সংগঠিত হওয়ার একটি ঐতিহাসিক উদাহরণ। এর প্রতিটি পদক্ষেপে ছিলো আত্মত্যাগ, প্রত্যয় ও মজলুম মানুষের অমিতশক্তির নিঃশব্দ বিস্ফোরণ। এই বিস্ফোরণে বারুদ ঢেলেছে শিল্প-সাহিত্য ও সাংস্কৃতিক অঙ্গনের কিছু সাহসী ব্যক্তি ও সংগঠন। তাদের লেখা ছড়া-কবিতা শ্লোগান হয়ে উচ্চারিত হয়েছেন। তাদের গান হয়ে উঠেছে প্রতিবাদের হাতিয়ার। তাদের গল্প-উপন্যাস এবং নাটক-সিনেমা থেকেও উজ্জীবনী শক্তির পরশ মিলেছে। গণঅভ্যুত্থান সংঘটনকালীন অভিজ্ঞতা, চ্যালেঞ্জ ও ভবিষ্যৎ কর্মপরিকল্পনা নিয়ে নানা ধরনের নানা মতামত থাকলেও মূলত, কোনো আন্দোলনই  কোনো ব্যক্তি, সংগঠন কিংবা প্রতিষ্ঠানের একক ফসল হিসেবে সংঘঠিত হতে পারে না। দেশের প্রতিটি অঙ্গনের প্রতিটি মুক্তিকামী মানুষের ঘাম আর রক্তের ফসল এই গণঅভ্যুত্থান; চব্বিশের জুলাই বিপ্লব।

    ফ্যাসিবাদের সাংস্কৃতিক রাজনীতি ও তারুণ্যের গণঅভ্যুত্থান

    আওয়ামী লীগ সরকারের দীর্ঘ ১৭ বছরের শাসনামলে দেশে এক ভয়ংকর নিপীড়নের চিত্র তৈরি হয়। গুম, খুন, দমন-পীড়ন, বাকস্বাধীনতার হরণ, মুদ্রাস্ফীতির ভয়াবহতা, অর্থনৈতিক বৈষম্য, বেকারত্বের করালগ্রাস- সবকিছু মিলিয়ে সাধারণ মানুষ ভেতরে ভেতরে ক্ষোভে ফুঁসছিল। রাষ্ট্রের প্রতিটি স্তরে দুর্নীতি ও ক্ষমতার অপব্যবহার যেনো নাগরিক জীবনের প্রতিটি স্তরে বিষ ছড়িয়ে দিয়েছিল। এরই মাঝে ২০১৮ সালের কোটা সংস্কার আন্দোলনের পরিপত্র বাতিল করে আদালত, যা তরুণ সমাজের চাকরি পাওয়ার বুকভরা আশাকে গুঁড়িয়ে দেয়। সেই রায়ের এবং বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে শিক্ষার্থীরা আবার রাস্তায় নামতে বাধ্য হন। সংকট এতোটাই গভীর ছিলো যে তরুণদের সামনে আর কোন বিকল্প পথ খোলা ছিলো না। সেখান থেকেই এই অভ্যুত্থানের যাত্রা।

    ফ্যাসিবাদের এই অগণতান্ত্রিক ও জনসম্মতিহীন শাসনকাঠমো স্রেফ গায়ের জোরে টিকে ছিল- ব্যাপারটা এতটা সরলও নয়। গুম, খুন, ক্রসফায়ার, নিবর্তনমূলক আইন, অবাধ লুটপাট, দুর্নীতি ইত্যাদির মাধ্যমে বিগত আওয়ামী শাসন চিহ্নিত হবে ঠিকই; তবে ভুলে গেলে চলবে না যে এ শাসনের পেছনে ক্রিয়াশীল ছিলো এক বিশেষ ধরনের সাহিত্য-সাংস্কৃতিক ও ঐতিহাসিক রাজনীতি। ফ্যাসিবাদী শাসনের পক্ষে উপযুক্ত বয়ান দাঁড় করাতে পেরেছিল বলেই আওয়ামী লীগকে ‘বিকল্পহীন’ মনে হত। মুক্তিযুদ্ধের একপেশে, একচেটিয়া ও বিকৃত ইতিহাস অবলম্বনে গড়ে উঠেছিলো সেই বয়ান। প্রকৃত মুক্তিযুদ্ধের সঙ্গে এর সর্ম্পূক ছিলো অতিসামান্য। ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের জনগণের শ্রেষ্ঠতম অর্জন। এই অর্জনকে দলীয় স্বার্থে ব্যবহার করার মধ্য দিয়ে সংকীর্ণ ও একপেশে ‘মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’র বয়ান তৈরি করা হয়েছিলো। অনেকেই এই বয়ানকে ‘বাঙালি জাতিবাদ’ হিসেবে অভিহিত করে থাকেন। মুক্তিযুদ্ধের চেতনার বয়ান অনেক ক্ষেত্রেই খোদ মুক্তিযুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়েছিলো। ইতিহাসের দলীয়করণ ছাড়াও গুম, খুন, অবৈধ শাসনসহ যাবতীয় অপরাধের বৈধতা দিতে এই বয়ান কাজ করেছে। এভাবে জনগণের এজমালি অর্জন মুক্তিযুদ্ধকে দূরে ঠেলে দিয়ে স্রেফ চেতনার রাজনীতি হিসেবে ক্রিয়াশীল রেখেছিলো তারা।

    আন্দোলনের বীজ বপন করেছিলেন শিক্ষার্থীরা, কিন্তু সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তা ছড়িয়ে পড়ে সাধারণ মানুষের হৃদয়েও। ফলে আন্দোলনের সাথে ক্রমান্বয়ে সকল শ্রেণি পেশার মানুষ যুক্ত হয়েছিলেন, বিশেষ করে নিম্নমধ্যবিত্ত ও নিম্ন আয়ের মানুষের অংশগ্রহণ ছিল চোখে পড়ার মতো। এমনকি প্রবাস থেকে বাঙালি-অবাঙালিদের আন্দোলনে অংশগ্রহণ এক অবিস্মরণীয় ঘটনা। আন্দোলনের সবচেয়ে হৃদয়গ্রাহী ছিলো ছিন্নমূল কিশোর ও তরুণদের অংশগ্রহণ যাদেরকে সমাজ ‘টোকাই’ বলে দূরে সরিয়ে দেয়। তারা এসেছিলো সামনে থেকে লড়তে। শিক্ষকরা শুরুতে অনেকটা নির্লিপ্ত থাকলেও, শেষ দিকে অনেকেই আমাদের পাশে দাঁড়ান। কেউ খাবার দেন, কেউ আশ্রয়, কেউ লাঠিসোঁটা সব মিলিয়ে আন্দোলন একটি বৃহৎ মানবিকতা-ভিত্তিক বন্ধনে পরিণত হয়েছিলো। ৩ আগস্ট ছাত্র নেতৃত্ব ঘোষিত এক দফার ভাষায় ছিল ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার বিলোপ এবং নতুন রাজনৈতিক বন্দোবস্ত কায়েম। অর্থাৎ স্রেফ ফ্যাসিস্ট শক্তি নয়, ফ্যাসিবাদী ব্যবস্থার দিকেই নিশানা তাক করেছে ছাত্রসমাজ। দীর্ঘ সময় ধরে গড়ে ওঠা এজমালি ভাষার জগৎ এবং বুদ্ধিবৃত্তিক প্রস্তুতি ছাড়া এ রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা কল্পনা করা যায় না।

    এই আন্দোলনে সবচেয়ে বড় চ্যালেঞ্জ ছিল ‘ভয়ের সংস্কৃতি’ ভেঙে আন্দোলনকে জাতীয় রূপ দেওয়া। যেকোন আন্দোলনকে শিবির বা বাম ট্যাগ দিয়ে দমন করা হতো। আর ১৬ জুলাই থেকে ব্যাপক গ্রেফতার এবং গুলি করে হত্যার মতো খোলামেলা দমন শুরু হলে তখন নেতৃত্ব ধরে রাখাই বড় কঠিন হয়ে পড়ে। সেই সংকট মোকাবেলায় শিক্ষার্থীরা একাধিক স্তরের নেতৃত্ব গঠন করেন; যাতে কেউ শহীদ হলেও আন্দোলন যেন থেমে না যায়। আর ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় গ্রেফতার-নির্যাতনের খবর ছড়িয়ে দেওয়াও কঠিন হয়ে পড়ে। তাদের নিজেদের মধ্যেও যোগাযোগ কঠিন হয়ে যায়। তবুও খুদে বার্তা ও ফোনকলের মাধ্যমে সাধ্যমতো সত্যটা জানানোর প্রয়াস চালানো হয়েছে। এমনকি বর্ডার পার করে ভারতে লোক পাঠিয়ে বর্বরতার তথ্যগুলো ছড়িয়ে দিয়ে বিশ্বব্যাপী জনমত তৈরির চেষ্টা করা হয়।

    দীর্ঘদিনের একদলীয় শাসনে ‘বাক স্বাধীনতা’ শুধু কণ্ঠে নয়, চেতনায়ও রুদ্ধ হয়ে গিয়েছিলো। এই আন্দোলন সেই দেয়াল ভেঙেছে। মানুষ আজ প্রশ্ন করতে শিখেছে, নিজের মতো করে কথা বলতে পারছে- এটাই সবচেয়ে বড় বিজয়। যদিও এই স্বাধীনতার কিছু অপব্যবহারও হচ্ছে, বিশেষ করে আন্দোলনের নেতাদের নিয়ে বিভ্রান্তি ছড়ানো হচ্ছে তবুও মুক্ত কণ্ঠের উন্মেষই একটি গণতান্ত্রিক জাতির প্রধান অর্জন। পুরোনো রাজনীতির সংস্কার, ডিজিটাল ও বিশ্বায়নের যুগে রাজনীতির আধুনিকায়ন, গ্লোবাল সংস্কার ও নতুন চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা এবং ইনসাফ প্রতিষ্ঠায় তারুণ্যের শক্তি ও উদ্ভাবনী ক্ষমতার ব্যবহার জরুরি। পরিবর্তিত বাংলাদেশে তরুণদের ইতিবাচক ও সক্রিয় অংশগ্রহণ গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করবে এবং দেশের মানুষের আকাঙ্ক্ষা পূরণে অগ্রণী ভূমিকা রাখবে।

    চব্বিশের জুলাইয়ে সাহিত্য-সাংস্কৃতিক প্ল্যাটফর্ম

    আলো-আঁধারিতে ছায়ার মতোই লেপ্টে থকে সাহিত্য। আলোকিত সাহিত্য জীবনকে আলোর পথ দেখায়; কুরুচিসম্পন্ন সাহিত্য ডেকে নিয়ে যায় অন্ধকারে। রাজনীতিও তাই। জীবনে ও ছায়ার মতোই সাহিত্য ও রাজনীতি একে অন্যের সঙ্গে নিবিড়ভাবে লেপ্টে রয়েছে। এটা প্রায়ই পরস্পরকে প্রতিফলিত ও প্রভাবিত করে। সাহিত্য ধরে রাখে সময় এবং তা কাজ করে সে সময়ের সামাজিক-রাজনৈতিক আয়না হয়ে। সাহিত্য রাজনৈতিক অভিব্যক্তি, সমালোচনা এবং প্রচারের একটি শক্তিশালী মাধ্যম।

    রাজনীতি শুধু রাজ্য নীতির বিষয় নয়। রাজনীতি শুধু কোনো নির্দিষ্ট কুক্ষিগত ক্ষমতা নয়। রাজনীতি শুধু মঞ্চের ভাষণ নয়। রাজনীতি শুধু খবরের কাগজে পড়ার বস্তু নয়। রাজনীতির সঙ্গে জড়িয়ে আছে আমাদের প্রতিদিনের বাজারের দরদাম, বাসাভাড়া, শিক্ষা, সংহতি, ব্যবহার, চলাফেরা, রাতে নিশ্চিন্তে ঘুমুতে যাওয়া, কথা বলা, এমনকি সৃজনশীলতা ও শিল্প-সাহিত্যেও। এমনকি বিশ্বাসের মূলধারাতেও ফ্যাসিবাদী রাজনীতি পুরোদস্তুর রাজত্ব চালিয়েছে।

    রাজনীতিসহ ইতিহাসের নানা বাঁকে সাহিত্যের সরব উপস্থিতি লক্ষণীয়। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলন, ভাষা আন্দোলন, শিক্ষা আন্দোলন, ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থান, মুক্তিযুদ্ধ ও ’৯০-এর স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনে সাহিত্য-সংস্কৃতির নান্দনিক প্ল্যাটফর্মটি অসাধারণ ভূমিকা পালন করে এসেছে। ২০২৪ সালের আন্দোলনে সাহিত্য-সংস্কৃতি কর্মীদের সক্রিয় ভূমিকা ছিলো। স্বৈরাচারী সরকার কারফিউ, দমন-পীড়নের মাধ্যমে আন্দোলন থামাতে চাইলেও সাহিত্য-সংস্কৃতি কর্মীরা ভয়কে উপেক্ষা করে ছাত্রদের পাশে দাঁড়িয়েছিলেন। মধ্য জুলাই থেকে বৈষম্যের বিরুদ্ধে ছাত্র-জনতার লড়াইয়ে শামিল হন শিক্ষক-আইনজীবী-সংস্কৃতি কর্মীসহ বিভিন্ন শ্রেণি পেশার মানুষ। যাদের বিচরণ শ্রেণীকক্ষে, অভিনয়ের মঞ্চে কিংবা আদালতে। ছাত্রদের পক্ষে তাদের উচ্চারিত কণ্ঠ রূপ দেয় গণঅভ্যুত্থানে। উনসত্তরে রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক অধ্যাপক শামসুজ্জোহাকে প্রাণ দিতে হয় ছাত্রদের পক্ষ নেয়ায়। গণঅভ্যুত্থানে অধ্যাপক শামসুজ্জোহার সেই সাহসিকতার প্রতিচ্ছবি দেখা যায় চব্বিশেও। শিক্ষকদের মধ্যকার সাহসী অনেকেই জুলাইয়ের শুরু থেকেই তাদের প্রতিবাদী ভূমিকা আলো-ছায়া হয়ে দেখা দেয় শিক্ষার্থীদের।

    যুগে যুগে সমাজের নানা অসঙ্গতি ত্রুটি বিচ্যুতি ছড়ার মাধ্যমে তুলে ধরেছেন ছড়াকার কবি এবং শিল্পীরা। সমাজ, রাজনৈতিক অধিকার ও ভূমিকা পালন করেছে ছড়া, কবিতা, গান এবং নাটক-সিনেমা। শাসকের রোষানল থেকে বাঁচতে প্রথম দিকের রাজনৈতিক ছড়ায় কিছুটা উপমাকেন্দ্রীক আড়ালে আবডালে প্রতীকী প্রতিবাদ করতেন তারা। যেমন- ‘খোকা ঘুমালো, পাড়া জুড়ালো, বর্গী এল দেশে’ নবাব আলীবর্দী খাঁর শাসনামলে বর্গীদের হামলা ও লুটতরাজের কথা প্রকাশিত হয়েছে উল্লেখ্য ছড়াটিতে।

    পরবর্তীকালে সরাসরি কথা বলার বিষয়টি সামনে চলে আসে। স্বাধীনতা উত্তর বাংলাদেশে রাজনৈতিক নীতি-দর্শন, আবেগ ও অধিকার, জুলুম ও স্বাধীকার প্রশ্নে ছড়াকার, কবি ও শিল্পীগণ কোনরকম রাখঢাক ছাড়াই সমাজ বদলের জন্য সৃজনশীলতাকে ব্যবহার করেছেন। ‘ধরা যাবে না, ছোঁয়া যাবে না, বলা যাবে না কথা, রক্ত দিয়ে পেলাম শালার, আজব স্বাধীনতা।’ এমন বিপ্লবী ছড়াবারুদ ঢেলে স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে গর্জে উঠেছিলেন মুক্তিযোদ্ধা ছড়াকার আবু সালেহ। নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনেও আমাদের ‘পল্টনের ছড়া’ ঝলসে উঠেছিলো। ছড়াকার সাজজাদ হোসাইন খানের ‘স্বৈরাচারের ঐরাবত’ ছড়াগ্রন্থ গর্জে উঠেছিলো নব্বইয়ের আন্দোলনেই। তারপর আর থামেনি সেই গর্জন। ‘আওয়ামী জাহেলিয়াত’ খেতাব দিয়ে ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে কলম শাণিত রেখেছেন কবি আবদুল হাই শিকদার। ‘পাথরে পারদ জ্বলে জলে ভাঙে ঢেউ, ভাঙতে ভাঙতে জানি গড়ে যাবে কেউ’ ভাঙা গড়ার এমন সাহসের বাতি জ্বালিয়েছেন কবি মোশাররফ হোসেন খান। কবি সোলায়মান আহসান ‘নাকপোড়া বারুদের গন্ধে’ ছড়িয়ে দিয়েছেন বিদ্রোহের বারুদ। ‘গণঅভ্যুত্থান চব্বিশ স্বাধীনতার কবিতা’ নামে পুরোদস্তুর একটি কাব্যগ্রন্থই প্রকাশ করেছেন কবি হাসান আলীম। ২০১০ সালে ঢাকার আত্মপ্রকাশ থেকে বিস্ফোরিত হয় আরেকটি ছড়াগ্রন্থ ‘ছড়ামাইট’। মাহফুজুর রহমান আখন্দ, এফ শাহজাহান, রফিক রইচ এবং এ কে আজাদ ছিলেন এই গ্রন্থের ছড়াকার। প্রত্যেকের ৩০টি করে ছড়াবারুদ নিয়ে বইটি প্রকাশিত। এই যাত্রা চলমান থেকেছে চব্বিশের ৩৬ জুলাই পর্যন্ত।

    জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সাইমুমসহ সারাদেশের শিল্পীগোষ্ঠীগুলো যেমন কর্মতৎপর ছিলো তেমনি অনেক সাহসী গুণীশিল্পী মাঠে নেমেছিলেন কণ্ঠযোদ্ধা হিসেবে। মূলত, সাহিত্য ও সংস্কৃতির ভূমিকা ছিলো প্রধানত জনসচেতনতা বৃদ্ধি, প্রতিবাদের ভাষা তৈরি এবং গণঅভ্যুত্থানের স্পিরিট বা চেতনাকে ছড়িয়ে দেওয়ার মাধ্যমে। বিগত দিনের গণআন্দোলনের মতোই এই অভ্যুত্থানে কবি, লেখক, শিল্পী এবং ছড়াকাররা সরাসরি অংশগ্রহণ করেন, বিভিন্ন বই ও সংকলন প্রকাশ করেন, যা গণমানুষের মধ্যে প্রতিবাদের আকাঙ্ক্ষা তৈরি করে এবং একটি ‘সাংস্কৃতিক আন্দোলন’ হিসেবে কাজ করে।

    চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে সবচেয়ে বড় নেয়ামক শক্তি হিসেবে আর্বিভূত হয়েছিলেন কাজী নজরুল ইসলাম। তাঁর গান এবং কবিতা আন্দোলনে নতুন করে ঝংকার তুলেছিলো। ইতোপূর্বে যেভাবে ব্রিটিশ ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে তীব্র সমালোচনার ঝড় তুলেছিলো, তেমনিভাবে ১৯৫২ সালের ভাষা আন্দোলন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থান, ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধ এবং ১৯৯০ সালের স্বৈরাচারবিরোধী আন্দোলনকে গভীরভাবে প্রভাবিত করেছিলো। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে কাজী নজরুল ইসলাম ছিলেন সুপার নায়কের আসনে। সেইসাথে কবি ফররুখ আহমদ, আল মাহমুদ, মতিউর রহমান মল্লিক, কবি গোলাম মোহাম্মদ ও আসাদ বিন হাফিজের গান-কবিতা ছিলো আন্দোলনের উত্তাল তরঙ্গের হাতিয়ার।

    এমনিভাবে জুলাই গণঅভ্যুত্থানেও স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে আন্দোলনকারীরা ছড়ায় ছন্দে ক্ষুব্ধ শ্লোগান তোলেন, “তুমি কে? আমি কে? রাজাকার, রাজাকার!; কে বলেছে, কে বলেছে; স্বৈরাচার, স্বৈরাচার।” এবং “চাইতে গেলাম অধিকার/ হয়ে গেলাম রাজাকার।” এরপরই ছাত্রদের উপর হাসিনার নির্বিচারে গুলি শুরু হলে আমাদের ছড়াকার কবি ও শিল্পীরাও তৎপর হয়ে ওঠেন স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে। সেই দুঃশাসনে চিত্র আমরা দেখতে পাই কবিতা, ছড়া ও কালজয়ী গানে। ইথুন বাবুর লেখা ও সুরে ‘দেশটা তোমার বাপের নাকি করছো ছলাকলা’, মাহফুজুর রহমান আখন্দ’র কথা এবং মাহফুজ মামুনের সুরে ‘আঁধার চিরে সূর্য ওঠার সময় এসেছে/ দিকে দিকে আমজনতা জেগে উঠেছে’ কিংবা ‘চলো কুরানের কর্মীরা হাতে রাখি হাত, সাহসের দীপ জ্বেলে সরাবোই রাত’ শিল্পী সাইফুল্লাহ মানছুরের সুরে ‘বুক জুড়ে রাসূলের মানবিক প্রেম’; বিলাল হোসাইন নূরী’র কথা ও রাআদ ইজামার সুরে ‘আয় তারুণ্য আয়’ নূরুজ্জামান শাহ’র কথায় রাআদ ইজামার সুরে ‘বইছে বাতাস বৈরী তৈরী থেকো তৈরী’ ও নিয়ামুল হোসাইনের সুরে ‘জেগেই যখন উঠেছো বন্ধু খালি হাতে ফিরিও না’। উস্তাদ তাফাজ্জাল হোসাইন খান, চৌধুরী গোলাম মাওলা, জাকির আবু জাফর, নয়ন আহমেদ, মনসুর আজিজ, আবু তাহের বেলাল, নাঈম আল ইসলাম মাহিন, ফজলুল হক তুহিন, তাজ ইসলাম, আবিদ আজম, মুন্সী বোরহান মাহমুদ, হাসনাইন ইকবাল, সীমান্ত আকরাম, আজিজ হাকিমসহ আশি-নব্বই ও নব্বই পরবর্তী তরুণ কবি-শিল্পীদের পক্ষ থেকে লড়াকু সৈনিকের মতো প্রতিবাদী গান-কবিতা গর্জে উঠেছে। সর্বোপরি, চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানে ১৫ জুলাই থেকে ৩৬ জুলাই পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছে অসংখ্য প্রতিবাদী র‌্যাপগান। ইতোমধ্যে সে বিষয়গুলো নিয়ে একটি সংকলন প্রকাশিত হয়েছে আলোকচিত্রী ও অ্যাকটিভিস্ট মনজুর হোসেনের সম্পাদনায়। সংকলনের বিভিন্ন বিষয়ে দুর্বলতার অভিযোগ থাকলেও এটি একটি প্রামাণ্য উদাহরণ হয়ে থাকবে।

    শুধু লেখাতেই নয়; আন্দোলনের মাঠেও ছিলেন ছড়াকার-কবি এবং শিল্পীরা। নব্বইয়ের স্বৈরাচার বিরোধী আন্দোলনে আমরাও ছিলাম রাজপথে। দুই হাজার চব্বিশের ২৬ জুলাই সাহিত্য-সংস্কৃতিকর্মীরা ঢাকায় কারফিউ ভেঙে গানের মিছিল করে সাহস জুগিয়েছিলেন আন্দোলনকারীদের। জুলাইয়ের শেষ সপ্তাহে আন্দোলন দমাতে কঠোর রূপ দেখায় সরকার। ছাত্র-জনতার মিছিলে নির্বিচারে গুলিতে যখন ঘটছিলো জীবনের নিদারুণ অপচয়, সে সময় আইনজীবীদের কয়েকজন বিক্ষোভকারীদের ওপর গুলি না ছুঁড়তে, ২৯ জুলাই মাত্র আধাঘণ্টায় পিটিশন ড্রাফট করে আদালতে রিট করেন তারা। ডিবি অফিসে আটক থাকা ৬ সমন্বয়কের মুক্তির বিষয়টিও ছিলো রিটে। ৩০ জুলাই সাহিত্য-সংস্কৃতি কর্মীরা আবারও গানের মিছিল নিয়ে ঢাকা জিরো পয়েন্ট থেকে বাহাদুর শাহ পার্কের দিকে অগ্রসর হন। যদিও মিছিলে বাধা দেয় পুলিশ ও সেনাবাহিনী, তবু তারা রাস্তার ওপর বসে গান, কবিতা ও বক্তব্যের মধ্য দিয়ে সমাবেশ চালিয়ে যান।

    আগস্টের প্রথম দিন। সেদিন ছিলো ৩২ জুলাই। বৈষম্যবিরোধী ছাত্র আন্দোলনে প্রাণহানির সংখ্যা তখন হাজারের কাছাকাছি। এরকম সময়েই বিটিভি ভবনে শিল্পী সমাজের কয়েকজন তারকার প্রতিবাদী মানববন্ধন চোখে পড়ে। তবে, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে কিংবা প্রাণহানির জন্য দুঃখপ্রকাশের জন্য নয়, বিক্ষুব্ধ ছাত্র-জনতার হামলায় পুড়ে যাওয়া বিটিভি ভবনের জন্যই তাদের এই মায়াকান্না; হাহাকার। একইদিন ফার্মগেটে ভিন্ন দৃশ্য দেখে দেশবাসী। সেদিন শিল্পী সমাজের এক অংশ ফার্মগেটে অবস্থান নেন ছাত্রসমাজের পক্ষে। ২ আগস্ট অর্থাৎ ৩৩ জুলাই অনুষ্ঠিত হয় ‘দ্রোহযাত্রা’। জাতীয় প্রেসক্লাব থেকে শুরু হওয়া এই বিশাল মিছিল শহীদ মিনারে গিয়ে রূপ নেয় প্রায় পঁচিশ হাজার মানুষের সম্মিলনে। ঐদিনই সরকার পতনের এক দফা দাবি জানানো হয়। একইভাবে আন্দোলনের তপ্ত আগুন প্রজ্জ্বলিত হতে থাকে রংপুর, রাজশাহী, চট্টগ্রাম, সিলেট, খুলনাসহ সারাদেশে। ঢাকার বাইরেও লেখক-শিল্পী ও সংস্কৃতিকর্মীরা আন্দোলনের পক্ষে জোড়ালো ভূমিকা পালন করেন। আমরাও ছিলাম রাজপথে, মিছিলে শ্লোগানে। এরই ধারাবাহিকতায় ৫ আগস্ট শেখ হাসিনা সরকারের পতন ঘটে।

    আগামীর প্রত্যাশা ও সাহিত্য-সংস্কৃতির মৌলিক সংস্কার

    গণঅভ্যুত্থান সমাজের রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের আকাঙ্ক্ষা তৈরি করে। কেননা এটি রাষ্ট্রীয় নিপীড়ন, বৈষম্য ও অনিয়মের বিরুদ্ধে জনগণের সম্মিলিত প্রতিরোধের প্রকাশ। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে ২০২৪ সালের জুলাই-আগস্টের ছাত্র-জনতার আন্দোলন ছিলো দীর্ঘদিনের সামাজিক হতাশা ও রাজনৈতিক অচলাবস্থার বহিঃপ্রকাশ। এই গণআন্দোলনের অভিঘাত শুধু রাজনীতিতেই নয়, সমাজ ও সংস্কৃতির ভেতরেও ছড়িয়ে পড়ে। এই প্রতিবাদের অভিঘাত কেবল শাসনব্যবস্থা নয়, সমাজ ও সংস্কৃতির গভীর তলদেশেও অনুরণন তুলেছে।

    আমরা যে মাটিতে এখন দাঁড়িয়ে সে মাটিতেও যেমন লেগে আছে অজস্র আন্দোলনে শহীদ হওয়া আমাদের ভাইবোনদের রক্ত। সাহিত্যের ছেঁড়া পাতা থেকে শুরু করে প্রাপ্তি-অপ্রাপ্তিতে ভরপুর নানা লেখায়ও এ রক্তের ছোপ ছোপ দাগ দগদগে স্মৃতি হয়ে আছে। রাজনৈতিক পরিবর্তন, সংগ্রাম এবং সামাজিক সমস্যা বাংলাদেশি সাহিত্যে বারবার উঠে এসেছে। এসব সাহিত্য শুধু দেশের সাংস্কৃতিক পরিচয় গঠনে ভূমিকা পালন করেনি বরং রাজনৈতিক চেতনা ও সামগ্রিক সমাজ পরিবর্তনের একটি গুরুত্বপূর্ণ মাধ্যম হিসেবে ভূমিকা রাখছে। এই গণঅভ্যুত্থানে একক কারো অবদান নেই। যে কথা বলেছে এবং যে কথা বলেনি, এমনকি যে চুপে চুপে ফ্যাসিবাদকে ঘৃণা করেছে তারও অবদান আছে। কিন্তু এই জুলাইয়ের স্পিরিট ছড়িয়ে দিতে কবি, লেখক, শিল্পীদের ন্যারেটিভ বা বয়ান তৈরি করতে হবে। সকল শ্রেণির মানুষের কাছে এর গল্প মুখে মুখে তুলে দিতে হবে। তখনই এটা সার্থক হবে। এখন এটা আমাদের সবার দায়িত্ব।

    গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশের রাজনীতি, সমাজ ও সংস্কৃতির অবস্থা ও আকাঙ্ক্ষাগত বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা অব্যাহত রাখতে হবে। গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী বাংলাদেশে সংস্কৃতির চেহারায় এক নতুন জাগরণ প্রত্যাশিত। দীর্ঘদিনের রাজনৈতিক গোঁজামিল, ফ্যাসিবাদের ছায়া এবং দমন-পীড়নের সংস্কৃতি সংস্কারপ্রবণ সমাজে রূপান্তরিত হতে শুরু করেছে। এই পরিবর্তনের কেন্দ্রে রয়েছে গণমানুষের অংশগ্রহণ, প্রশ্ন করার সাহস এবং নতুন এক নৈতিক বোধের উন্মেষ। শিল্প, সাহিত্য, নাটক ও সংগীতে পুনর্জাগরণের সম্ভাবনা জাগছে। প্রতিবাদ, প্রতিরোধ এবং মুক্তির ভাষা ফিরে আসছে কবিতা, গান ও চিত্রকলায়। শহর থেকে গ্রাম সর্বত্র মানুষ এখন সংস্কৃতিকে শুধু বিনোদনের মাধ্যম নয়, বরং মতপ্রকাশ ও সামষ্টিক চেতনার বাহক হিসেবে দেখতে শুরু করেছে।

    বাংলাদেশের ইতিহাসে সংস্কৃতি সবসময়ই ছিলো প্রগতির বাহক, বৈচিত্র্য ও মানবিকতার প্রতিচ্ছবি। কিন্তু এই সাংস্কৃতিক ধারার বিপরীতে ফ্যাসিবাদী শক্তি সবসময়ই সক্রিয় থেকেছে। তাদের উদ্দেশ্য সুস্পষ্ট। সমাজকে একমাত্রিক, সংকীর্ণ ও অচল চিন্তার খাঁচায় আবদ্ধ করা। যেখানে প্রশ্ন নেই, ভিন্নমত নেই, কল্পনা বা সৃজনশীলতার জায়গা নেই। ফ্যাসিবাদের আঘাত প্রথম আসে চিন্তার ওপর। তারা সাহিত্যে ‘অশ্লীলতা’ অনুপ্রবেশ করায়, চিত্রকলায় মানবিক অবমাননা প্রতিকিৃত নির্মাণ করে, গানে পরিশুদ্ধতার বিপরীতে মানবধর্মের নামে শির্কের অনুপ্রবেশ ঘটায়। নাটকে মুক্তিযুদ্ধের ‘চেতনা সালসা’র নামে জাতির মধ্যে বিভাজনের দেয়াল তৈরি করে দিয়েছিলো। স্বতন্ত্র ভাবনার প্রকাশ পেলেই মৌলবাদী ট্যাগ দিয়ে তাঁকে একঘরে করা হয়েছে। ইতিহাসের নায়ক হিসেবে একমাত্র একজনের কৃতিত্বই ঐতিহাসিক দলিল হিসেবে উপস্থাপন করা হয়েছে। এই আঘাত শুধু মননে নয়, কখনো কখনো প্রাণঘাতীও হয়েছে। শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির ইতিবাচক কর্মীদের অনুষ্ঠানের অনুমতি মেলেনি। নিজেদের আয়োজনে কোনো অনুষ্ঠান হলেও সেখানে মঞ্চে হামলা, শিল্পীর ওপর হামলা এবং জেল-জুলুমের শিকারও হতে হয়েছে।

    গণঅভ্যুত্থান কেবল রাজনৈতিক পরিবর্তন আনেনি, বরং সংস্কৃতিতে দিয়েছে নতুন ভাষা ও মননচর্চার দিগন্ত। এই নবজাগরণে তরুণরা পুরোনো দাসত্বমনা সংস্কৃতিকে অস্বীকার করেছে। তারা নতুন মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠায় সচেষ্ট। সামাজিক গণমাধ্যম, ছোট পত্রিকা, পথনাটক এবং বিকল্প সাহিত্যমাধ্যম এখন তাদের হাতিয়ার। একইসঙ্গে রাষ্ট্রীয় প্রতিষ্ঠানগুলোতেও সংস্কৃতি নিয়ে নতুন করে ভাবনা শুরু হয়েছে; তথ্য, ইতিহাস ও স্মৃতি রচনার দায়িত্বের প্রতি আগ্রহ দেখা যাচ্ছে। গণঅভ্যুত্থান পরবর্তী সময়ে জনগণের সংস্কৃতি হতে হবে অধিকতর সচেতন, অংশগ্রহণমূলক ও আত্মমর্যাদাশীল। দীর্ঘদিনের দমন-পীড়ন ও ভয়ভীতির আবহে যে সাংস্কৃতিক শূন্যতা তৈরি হয়েছিল, তা জনগণের সচেতন অংশগ্রহণের মধ্য দিয়ে ভরাট হতে শুরু করেছে। এখন আর সাংস্কৃতিক আধিপত্যবাদ মেনে নেয়া হবে না। নিজেদেরকেই সংস্কৃতির নির্মাতা হতে হবে। এই নতুন সংস্কৃতি হবে বিশ্বাসের, নৈতিকতার, মানবিক মূল্যবোধের। 

    ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের সংস্কৃতায়িত বাংলাকে বাংলাদেশের কথ্য ও লেখ্য ভাষা হিসেবে প্রতিষ্ঠা করার চূড়ান্ত প্রয়াস চালানো হয়েছে ফ্যাসিবাদী সাহিত্য-সাংস্কৃতিক বলয় থেকে। ভাষার মধ্যে বাংলাদেশের মানুষের বোধ-বিশ্বাস ও তাহযিব-তমদ্দুনিক শব্দসমূহকে মৌলবাদী বলে দূরে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। চিন্তা-চেতনা, ইতিহাস ও সংস্কৃতির বয়ানে ধর্মীয় ঐতিহ্যকে সুকৌশলে আধুনিকতার ছদ্মাবরণ দিয়ে নতুন প্রজন্মের কাছ থেকে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। বাংলাদেশের ৯০ ভাগ মানুষ যে ভাষায় কথা বলেন সেটাই আমাদের মৌলিক ভাষা। সেই ভাষা আমাদের বইয়ের ভাষার সাথে খাপ খাইয়ে চলতে পারেনি। বিশ্বাস ও মূল্যবোধের সাথে চিরায়ত জীবনের মৌলিক তফাৎ খুঁজে পাওয়া গেছে আমাদের প্রিন্ট ও ইলেক্ট্রনিক মিডিয়ার ভাষার ভেতরে। বিশেষত আধুনিকতা ও স্মার্ট জেনারেশন তৈরির নামে তাদেরকে আমাদের প্রাত্যহিক জীবনের ব্যবহারিক শব্দের ঐতিহ্য থেকে দূরে সরিয়ে ফেলা হয়েছে। ঠিক যেনো, আমাদের বিশ্বাসের ধারা এক রকম আর পড়ি, শুনি এবং দেখি আরেক ভাষার ঐতিহ্যে।

    দেশের মাটি ও জনসমাজ থেকে উঠে আসা সাহিত্যই নতুন প্রজন্মকে পড়াতে হবে। জুলাই অভ্যুত্থান আমাদের জন্য সেই সুযোগ তৈরি করে দিয়েছে। জুলাই অভ্যুত্থানের কথাবার্তা ও শ্লোগান আমাদের মুখের ভাষায় হয়েছে। সেখানে আমাদের বিশ্বাস এবং ঐতিহ্যের প্রতিফলন ঘটেছে। এখন দরকার আমাদের পেছনের ভুল সংশোধন করে দেশের মানুষের ভাষা ও সাহিত্যকে সামনে নিয়ে আসা। যে ভাষা বাংলাদেশের মাটি ও মানুষের ঘ্রাণমিশ্রিত; যা আরবি-ফারসিসহ বিভিন্ন ভাষা থেকে এসে বাংলাভাষাকে সমৃদ্ধ করেছে। বাংলাভাষাকে সেই মর্যাদার জায়গায় ফিরিয়ে নিয়ে আসতে হবে। সেইসাথে আমাদের বাংলাদেশে বাঙালির বাইরেও বেশকিছু জাতিগোষ্ঠীর মানুষ আছেন। তাদের সাহিত্য ও ভাষা আমরা জানি না। তাদের ভাষার সাহিত্যগুলোকে তাদের নিজেদের মতো করে বিকশিত করার ক্ষেত্রে সহযোগিতার হাত সম্প্রসারিত করা উচিত। জুলাই গণঅভ্যুত্থানে রাস্তায় নেমেছিল এমন দুরন্ত কিশোরদের কেউ কেউ তাদের টিফিনের পয়সা বাঁচিয়ে ‘দেয়াল পত্রিকা’ প্রকাশ করেছে; সেই ইতিহাস আমাদের ভুলে গেলে চলবে না।

    সত্যিকার অর্থে, বাংলাদেশের মানুষের মুক্তির ঐতিহাসিক ও ধারাবাহিক কেন্দ্রবিন্দু হচ্ছে সাতচল্লিশ, একাত্তর এবং চব্বিশ। একটি আরেকটির অ্যান্টিথিসিস নয়। একাত্তরে সাতচল্লিশ বাতিল হয়নি; চব্বিশেও একাত্তর বাতিল হবে না। এ কথা সত্য যে সাতচল্লিশ ও একাত্তর-পরবর্তী রাজনৈতিক বন্দোবস্ত ব্যর্থ হয়েছে। তার মানে এই নয় যে সাতচল্লিশ-একাত্তর ব্যর্থ হয়েছে। চব্বিশের গণঅভ্যুত্থান নতুন গণতান্ত্রিক রাজনৈতিক বন্দোবস্তের সম্ভাবনা হাজির করেছে, কিন্তু তা কায়েমে ব্যর্থ হলে চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানকে ব্যর্থ বলার কোনো সুযোগ থাকবে না।

    সাতচল্লিশ ও একাত্তর ‘ইতিহাসের প্রয়োজনে’ ঘটেছিল। ব্রিটিশ বিরোধী কোন তরুণ আজাদী সংগ্রামী পাকিস্তান আন্দোলনে অংশ নিয়েছিলেন, তিনি শেষ বয়সে এসে বলেননি যে, পাকিস্তান আন্দোলন করাটা ‘ভুল’ ছিল। ‘পাকিস্তান আজাদী আন্দোলন’ এবং পরবর্তী দমনমূলক ‘পাকিস্তান রাষ্ট্র’ এক কথা নয়। একইভাবে একাত্তরের মুক্তিযুদ্ধ আর ‘দলীয়  মুক্তিযুদ্ধের চেতনা’ এক কথা নয়। মুক্তিযুদ্ধ বাংলাদেশের আপামর জনগণের। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা বাঙালি জাতীয়তাবাদী ও সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির রাজনীতির প্রধান মতাদর্শিক হাতিয়ার। সাম্প্রদায়িক সম্প্রীতির গণতান্ত্রিক এক দেশ, সমাজ ও রাষ্ট্র গড়ে তুলতে হবে-এটাই চব্বিশের গণঅভ্যুত্থানের প্রধান দাবি। এ দাবিকে পূরণ করতে হলে এমন এক সাংস্কৃতিক-রাজনৈতিক আবহ প্রয়োজন, যা অন্তর্ভুক্তিমূলক, গণতান্ত্রিক ও পরমতসহিষ্ণু। কোনো না কোন বর্গে ফেলে বিভাজনের রাজনীতি শুরু করা ফ্যাসিবাদেরই নামান্তর। তাইতো গণঅভ্যুত্থানকে একটি ‘সাংস্কৃতিক আন্দোলন’ হিসেবে বিবেচনা করা হলেও ভুল হবে না। এখানে সাহিত্য-সংস্কৃতি একটি গুরুত্বপূর্ণ অস্ত্র হিসেবে ব্যবহৃত হয়। সাহিত্য ও সংস্কৃতির মাধ্যমে জনগণের মধ্যে স্বৈরাচারের বিরুদ্ধে সচেতনতা তৈরি করা হয় এবং প্রতিবাদের ভাষা তৈরি করা হয়। সাহিত্যিক ও সাংস্কৃতিক কর্মীরা তাদের সৃষ্টিশীল কাজের মাধ্যমে গণঅভ্যুত্থানে অংশগ্রহণকারীদের মধ্যে সংহতি ও ঐক্য তৈরি করতে ভূমিকা রাখেন। গণঅভ্যুত্থানের প্রেক্ষাপটে কবিতা, ছড়া, গান এবং অন্যান্য সাহিত্যকর্ম প্রকাশিত হয়, যা অভ্যুত্থানের ঘটনা ও মূল্যবোধকে ধারণ করে এবং সমাজের ‘ভয়ের সংস্কৃতি’ ভাঙতে সহায়তা করে।

    পরিশেষে বলা যায়, দুই হাজার চব্বিশের জুলাই গণঅভ্যুত্থান বাংলাদেশের সাহিত্যে জায়গা নিতে সক্ষম হবে তার প্রমাণ শুরুতেই পাওয়া গেছে। ১৯৪৫ সালে প্রকাশিত ‘অ্যানিমেল ফার্ম’ বইয়ের কথা আজও আমরা রেফারেন্স হিসেবে টেনে আনি রাজনৈতিক দর্শন বর্ণনা করতে গিয়ে। অতএব আমরা আশা করতেই পারি আমাদের ২০২৪ সালের জুলাই ‘জাতীয় সংস্কারের ইতিহাস’ হয়ে থাকবে। এই গণঅভ্যুত্থানের ইতিহাসে ছাত্রসমাজের অবদানের কথা যেমন উল্লেখ থাকবে তেমনি ছড়া-কবিতা, গান, গল্প-উপন্যাস ও সিনেমা-নাটকের ভূমিকাও জায়গা করে নেবে। ইতিহাসের ন্যারেটিভ তৈরিতে এই অভ্যুত্থানের তথ্যচিত্রসমূহও বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ দলিল হিসেবে কাজ করবে। সুতরাং পরিকল্পিত উপায়ে অভ্যুত্থান-পরবর্তী গণতান্ত্রিক, সাংস্কৃতিক ও বুদ্ধিবৃত্তিক উদ্যোগগুলোকে আরো জোরদার করার কোন বিকল্প নেই।

    [লেখক: কবি ও গবেষক; প্রফেসর, ইসলামের ইতিহাস ও সংস্কৃতি বিভাগ, রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়।]


    বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে সমন্বিত সাংস্কৃতিক সংসদ (সসাস)-এর ২০২৬ সালের প্রকাশনার মোড়ক উন্মোচন সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠান

    বিশ্বসাহিত্য কেন্দ্রে সমন্বিত সাংস্কৃতিক সংসদ (সসাস)-এর ২০২৬ সালের প্রকাশনার মোড়ক উন্মোচন

    জুলাই গণ-অভ্যুত্থান ও আমাদের সংস্কৃতির পুনর্নির্মাণ প্রবন্ধ

    জুলাই গণ-অভ্যুত্থান ও আমাদের সংস্কৃতির পুনর্নির্মাণ

    জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সাহিত্য-সাংস্কৃতিক প্ল্যাটফর্ম: ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক অবদান প্রবন্ধ

    জুলাই গণঅভ্যুত্থানে সাহিত্য-সাংস্কৃতিক প্ল্যাটফর্ম: ব্যক্তি ও প্রাতিষ্ঠানিক অবদান

    শিহরণ সাহিত্য সাংস্কৃতিক সংসদ, নারায়ণগঞ্জ মহানগরীর সীরাতুন্নবী (সা.) প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণী ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান সাংস্কৃৃতিক অনুষ্ঠান

    শিহরণ সাহিত্য সাংস্কৃতিক সংসদ, নারায়ণগঞ্জ মহানগরীর সীরাতুন্নবী (সা.) প্রতিযোগিতার পুরস্কার বিতরণী ও সাংস্কৃতিক অনুষ্ঠান

    বাংলা একাডেমির গবেষণামূলক প্রবন্ধ আহবান প্রবন্ধ

    বাংলা একাডেমির গবেষণামূলক প্রবন্ধ আহবান

    তাইরান লেখক সম্মাননা-২০২৫ পাচ্ছেন যারা সাহিত্য

    তাইরান লেখক সম্মাননা-২০২৫ পাচ্ছেন যারা

    দিনব্যাপী ছোটদের সময়–যুগপূর্তি শিশুসাহিত্য উৎসব ২০২৫, রেজিস্ট্রেশন চলছে সাহিত্য আসর

    দিনব্যাপী ছোটদের সময়–যুগপূর্তি শিশুসাহিত্য উৎসব ২০২৫, রেজিস্ট্রেশন চলছে

    শান্তির ছায়া প্রোডাকশন হাউজ প্রকাশ করল ইতিহাসভিত্তিক কার্টুন “শাহজালাল” অন্যান্য

    শান্তির ছায়া প্রোডাকশন হাউজ প্রকাশ করল ইতিহাসভিত্তিক কার্টুন “শাহজালাল”

    সীরাত স্মারকের মোড়ক উন্মোচন ও লেখক সম্মেলন অনুষ্ঠিত প্রকাশনা উৎসব

    সীরাত স্মারকের মোড়ক উন্মোচন ও লেখক সম্মেলন অনুষ্ঠিত

    রংপুরে দেশীয়'র সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত রংপুর

    রংপুরে দেশীয়'র সাংস্কৃতিক প্রতিনিধি সম্মেলন অনুষ্ঠিত